কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম বিধানসভা হল চৌরঙ্গি। পুরোনো চৌরঙ্গি বিধানসভার সিংহভাগ অঞ্চলই ২০০৯ সালে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে ভবানীপুর এবং বালিগঞ্জের মধ্যে৷ পুরোনো বউবাজার এবং শিয়ালদার সংমিশ্রণে তৈরি আধুনিক চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রটি। তবে এখানকার রাজনৈতিক ঐতিহ্যে পুরনো কেন্দ্রের মতোই৷ বরাবারই বাম বিরোধী হাওয়া দেখা গিয়েছে এই কেন্দ্রে। সাবেক চৌরঙ্গির মতো শিয়ালদা-বউবাজারও বরাবর কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিকেই লালনপালন করেছে৷ যা পরে রূপান্তরিত হয়েছে ঘাসফুলে। সেখানে থেকে এবার পদ্মের দিকে হাওয়া বদল হবে কিনা সেই প্রশ্নই এখন প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে এই বিধানসভা কেন্দ্রে। চৌরঙ্গিতে তৃণমূল ভরসা রেখেছে গতবারের বিজয়ী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। ২০১৬ প্রেস্ট্রিজ ফাইটে এখান থেকেই সোমেন মিত্রকে হারিয়ে ছিলেন নয়না। বলা হয় সেবার বকলমে নয়নার বদলে সোমেনের সঙ্গে টক্কর ছিল সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তারপর ৫ বছর কেটে গিয়েছে। ২০১৯ সালে ফের একবার উত্তর কলকাতা থেকে সাংসদ হয়েছেন সুদীপ। সোমেন মিত্র আর নেই। তৃণমূল এবারও সুদীপ জায়া নয়নার ওপরই ভরসা রেখেছে। একুশের ভোটে সোমেন ও সুদীপ লড়াই দেখা না গেলেও কিন্তু চৌরঙ্গিতে ফের একবার ঘাসফুল ফোটান নয়নার কাছে অতটা সহজ নয়। কারণ এখানে শাসক দলের পাল্টা শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিজেপি। আর হিন্দিভাষী ভোটররা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় কিছুটা হলেও অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে গেরুয়া শিবির।
সাংসদের বিধায়ক স্ত্রী
স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে রাজনীতিতে এমন উদাহরণ ভারত তথা বাংলায় বহু রয়েছে। তেমনি এক দম্পতি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৭ সালে প্রথমবার সিপিএমের মহম্মদ ইসমাঈলকে পরাজিত করে বউবাজার বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন সুদীপ। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠিত হলে আরও অনেক কংগ্রেসীর মত তিনিও দল বদলেছিলেন। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে কলকাতা উত্তর পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তবে ২০০৪ সালে ফের ঘর ওয়াপসি হয়েছিল সুদীপের। ফিরে গিয়েছিলেন কংগ্রেসে। ২০০৮ সালে ফের একবার সব দ্বন্দ্ব ভুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগদান। ২০০৯ থেকে নবগঠিত কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ। ইউপিএ আমলে কেন্দ্রের মন্ত্রীও হয়েছেন সুদীপ। এহেন রাজনীতিকের সঙ্গে ১৯৯১ সালের ২৫ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সেই সময়ের বাংলা সিনেমার অন্যতম নায়িকা নয়না দাস। আক্ষরিক অর্থে স্বামীর থেকেই রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন নয়না। ২০০১ সালে প্রথমবার বৌবাজার কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালে চৌরঙ্গি উপনির্বাচনে জয়লাভ। তারপর ২০১৬ সালেও এই কেন্দ্র থেকেও আরও একবার বিধায়ক।
২০১৬ লড়াই ছিল সম্মানের
সোমেন মিত্র ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দু'জনই কংগ্রেস ঘরানার রাজনীতিক। তবুও দু'জনের মধ্যে সবসময় টক্করের চোরাস্রোত বয়ে গিয়েছে বরাবর। প্রয়াত সোমেন মিত্রকে কখনই নিজের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী মনেই করতেন না সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ২০১৪ সালে সোমেন মিত্র তৃণমূল ছাড়ার পর ২০১৬ বিধানসভায় চৌরঙ্গিতে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়েছিলেন। সেবার নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাঝে রেখে তাঁদের লড়াই জমজমাট ছিল। কারণ সবাই জানতেন নয়নার বকলমে লড়াইটা আসলে ছিল সুদীপেরই৷ সেবার সম্মানের লড়াই জিতে গিয়েছিলেন সুদীপ। স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ৫৫,১১৯ ভোট। যা মোট ভোটের ৪৮.২৯ শতাংশ। অন্যদিকে সোমেন মিত্রের ঝুলিতে গিয়েছিল ৪১,৯০৩টি ভোট। যা মোট ভোটের ৩৫.৯৫ শতাংশ। বিজেপির রীতেশ তিওয়ারি পেয়েছিলেন ১৫,৭০৭ টি ভোট। হিসেব করলে মোট ভোটের ১৩.৪৮ শতাংশ। সেবার নয়না সোমেনকে হারিয়েছিলেন ১৩,২১৬ ভোটের ব্যবধানে।
নয়নার রাজনৈতিক যাত্রা
অভিনয় জগতের একাধিক ব্যক্তিত্বকে পরবর্তীতে অভিনয় জগতে যোগ দিতে দেখা গিয়েছে। আর প্রথম থেকেই তৃণমূলে গ্ল্যামার জগতের লোকেদের জন্য রয়েছে বিশেষ জায়গা। নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়েরও তেমনি আগমন সেলুলয়েডের দুনিয়া থেকে। ২০০১ সালে প্রথমবার বৌবাজার কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ২০১৪ সালে চৌরঙ্গিতে বিধানসভা উপনির্বাচনে নয়নাকে ফের টিকিট দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের নিরিখে সেই সময় চৌরঙ্গিতে কংগ্রেস দেড় হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূলের চেয়ে। তবে উপনির্বাচনে সব হিসেব ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন নয়না। চৌরঙ্গিতে ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন তিনি।
এবারের লড়াই কতটা কঠিন
চৌরঙ্গি এলাকা ঐতিহ্যগত ভাবে বাম-বিরোধী আসন বলেই পরিচিত। তবে গত কয়েক বছরে এখানে শাসক দলের পাল্টা শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিজেপি। এই কেন্দ্রে হিন্দিভাষী ভোটাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বিজেপি অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবারও ‘ক্লোজ ফাইট’-ই হতে চলেছে চৌরঙ্গিতে৷ ২০১৪ সালে চৌরঙ্গির উপনির্বাচনে কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠককে পিছনে ফেলে প্রথমবার বিজেপি দু’নম্বরে উঠে এসেছিল৷ গত বিধানসভায় অবশ্য় পের তিন নম্বরে নামতে হয়েছিল গেরুয়া দলকে। এবার শিয়ালদহ -বউবাজার -জানবাজার , লেনিন সরণির হিন্দিভাষী অঞ্চলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে পদ্মশিবির৷ অন্যদিকে নয়নার বিশেষ নজর চৌরঙ্গির সংখ্যালঘু এলাকায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছেন চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। এদিকে লোকসভা ভোটে এরাজ্যে আশাতীত ভালো ফল করেছে বিজেপি। এ বারও সেই হাওয়াকে ভর করেই বাংলা জয় করতে চাইছে বিজেপি। যদিও গত লোকসভায় চৌরঙ্গি কেন্দ্রে পিছিয়ে ছিল গেরুয়া শিবির। এবার সেই ভোট মেকআপ দিতে বড়ও চালও চেলেছিল গেরুয়া শিবির। চৌরঙ্গি আসনে প্রথমে শিখা মিত্রের নাম ঘোষণা করেছিল বিজেপি। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী শিখা মিত্র চৌরঙ্গি থেকে জয়ী হয়েছিলেন ৫৭,৭৩৯ ভোটে। সেবার কংগ্রেসের সমর্থনে তৃণমূলের হয়ে ভোটে লড়েছিলেন সোমেন মিত্রের পত্নি। ২০১৪ সালে সোমেন ঘরণী রাজনীতি ছাড়ার ফলেই এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন নয়না। যদি শিখা মিত্র এবার ভোটে লড়তে রাজি হতেন তাহলে আরও একবার সুদীপ-সোমেন লড়াইয়ে না থেকেও আলোচনায় উঠে আসতেন। যদিও একুশের ভোটে লড়তে রাজি হননি শিখাদেবী। তার বদলে গেরুয়া শিবিরের হয়ে ময়দানে নেমেছেন দেবদত্ত মাজি।
কে এই দেবদত্ত মাজি
হিন্দু সংগঠন সিংহবাহিনীর সভাপতি দেবদত্ত মাজি চলতি বছরের শুরুতেই বিজেপিতে যোগ দেন। তার সঙ্গে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন এই সংগঠনের আরও অনেক নেতা-কর্মী। তাঁকে দলে পেয়ে লাভ হবে বলেই মন্তব্য করেছিলেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। মেরুকরণেই ত্রাসই যেন চৌরঙ্গি কেন্দ্রে বিজেপির মূল বাজি।
২০১৪-লোকসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরেছিলেন সেই সময়ে সদ্য কংগ্রেসে যোগ দেওয়া সোমেন মিত্র। তবে সেবার চৌরঙ্গি বিধানসভায় কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পেয়েছিলেন সোমেন মিত্র৷ ওই কেন্দ্রে সুদীপের চেয়ে ১৫০০ ভোটে এগিয়ে ছিলেন সোমেন৷ কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে বিধানসভার উপনির্বাচনে সুদীপ জায়ার কাছে প্রায় ১৪,০০০ হাজার ভোটে হেরে সেই সান্ত্বনাটুকুও খোয়াতে হয়েছিল সোমেনকে৷ সাতবারের বিধায়ক ও একবারের সাংসদ সোমেন মিত্রকে হারিয়েছিলেন তাঁর তুলনায় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে থাকা নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার নতুন করে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া গেরুয়া শিবিরের হিন্দুত্ববাদী নেতার সঙ্গে লড়াইয়ে নিজের জমি ধরে রাখা কিন্তু নয়নার কাছে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ গতবার রাজনীতির মহিরূহকে হারিয়েছিলেন নয়না। আর এবার ধার-ধারে অন্যান্য প্রার্থীদের হয়ে এগিয়ে থাকা নয়নার কাছে নিজের জায়গা ধরে রাখাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।