scorecardresearch
 

বুদ্ধ থেকে মমতা- বাংলায় 'পরিবর্তন' বরাবরই একটা গুরুত্বপূর্ণ ইসু, বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

সেটা ২০০৬ সালের ঘটনা। বিধানসভার ভোট। অনেকেই ভেবেছিলেন, বিধানসভা ভোটে সিপিআইএম জিততে পারবে না। আর মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ক্ষমতায় আসতে চলেছেন। কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠকে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যয়ী কন্ঠে জানিয়েছিলেন, এর পরের বার সাংবাদিক করবেন মহাকরণে।

Advertisement
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হাইলাইটস
  • পরিবর্তন কে আনবে, মানুষ না দল?
  • মানুষ কি আরও একটা পরিবর্তনের জন্য তৈরি?
  • 'পরিবর্তন' খুব ভাল একটি শব্দ

সেটা ২০০৬ সালের ঘটনা। বিধানসভার ভোট। অনেকেই ভেবেছিলেন, বিধানসভা ভোটে সিপিআইএম জিততে পারবে না। আর মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ক্ষমতায় আসতে চলেছেন। কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠকে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যয়ী কন্ঠে জানিয়েছিলেন, এর পরের বার সাংবাদিক করবেন মহাকরণে। তিনি ভিক্ট্রি সাইনও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আশা পূরণ হয়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আরও কবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান ছিল, পরিবর্তন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে পরিবর্তন হয়নি। আর সিপিআইএমের বক্তব্য ছিল, এক নতুন সিপিআইএম। এমনই রণকৌশল ছিল তাদের। দলের পলিটব্যুরো বৈঠক থেকে ওই স্লোগানের উৎপত্তি। এবং যার নেতৃত্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাদের বক্তব্য ছিল আগের থেকেও ভাল সিপিআইএমকে দেখতে পাওয়া যাবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আরও ভালো সিপিআইএম গঠন করবেন। আরও ভাল বাংলা তৈরি করবেন। তখন চড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বিরোধী হাওয়া কিন্তু তারপরেও সিপিআইএমের সমস্যা হয়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ফের ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর তাই জন্য বাংলায় পরিবর্তন বরাবরই একটা ইস্যু। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাঁচ বছর সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের রাজনীতি, এজেন্ডা নিয়ে অনড় ছিলেন। তিনি অপ্রিয় পাত্র হয়ে থেকেছেন বিভিন্ন আন্দোলনের জন্য, তা সে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম আন্দোলন-যা-ই হোক। সেখানেও বার্তা ছিল পরিবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। 

ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। বিজেপি এখন সেই একই কথা ব্যবহার করছে, পরিবর্তন। ইংরেজদের শাসনের সময় কলকাতা ছিল রাজধানীর। ১৯১১ সালে তা বদলে হয় দিল্লিতে। বিজেপির মতে, উনিশ শতকের রেনেসাঁর শহরের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর এর জন্য বিজেপি দায়ী করছে বামপন্থী, কংগ্রেসের শাসনকালকে। তারা দোষারোপ করছে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরকে। তাদের অভিযোগ, বাংলাকে ওঁরা ধ্বংস করেছেন। তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি বাংলাকে পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে দেবে। আর তাই তারা ব্যবহার করছে সেই পুরনো শব্দ, পরিবর্তন। এই দিক থেকে দেখতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিপিআইএমের রাজনীতির বর্ধিত অংশ। বা বিজেপি যেটা হামেশাই বলে থাকে, সিপিআইএমের সবথেকে খারাপ ছাত্র হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তারা এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুসরণ করছেন। 

Advertisement

বিজেপি যেগুলো বলতে চাইছে-

প্রথমত, ক্লাব সংস্কৃতি। প্রত্যেকটা জেলায় অজস্র ক্লাব রয়েছে। নথিভুক্তিকরণের পর তারা সদস্যদের টাকা দিচ্ছে। ক্লাবে বেকারদের আনাগোনা রয়েছে। যেখানে অপ্রয়োজনীয় আর অভদ্র কাজকর্ম হয়। যাকে ঘুরিয়ে সরকার সমর্থন করছে। এমনই অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। বিজেপি বলতে চাইছে, রাজ্য সরকার পরোক্ষভাবে বেকারত্বকে সমর্থন করছে। তাদের যেহেতু সামান্য কিছু ভাতা দেওয়া হচ্ছে ঘুরিয়ে, তাই তাদের অবস্থা পরিবর্তনের কোনও দায় নেই সরকারের। 

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা। কলকাতার শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। ইংরেজ শাসনকালে লর্ড মেকলে। ইংরেজিতে লেখা পড়ার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। আর যেখান থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা, যার উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। শিক্ষা পাণ্ডিত্যের এই গৌরব এখন ম্লান হয়ে পড়েছে। যার ক্ষয় শুরু সিপিআইএম জামানা থেকে। যেখানে শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কাজ করে চলেছেন। 

তৃতীয়ত, শিল্পের অভাব। এরাজ্যে বলতে গেলে বড় কোনও শিল্প নেই। সিঙ্গুর থেকে টাটারা নিজেদের কারখানা গুজরাটে সরিয়ে নিল। যেটা ছিল গুজরাট মডেল। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেননি। তাই বাংলায় বিনিয়োগ করা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। এমনই সংস্কৃতি এখানকার। এখানেই শিল্পায়ন হলে অজস্র বেকার ছেলেমেয়ে কাজ পেত।

চতুর্থত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কোষাগারে এক বড়সড় অংশ খরচ হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিনোদন, মেলাতে। সাজানোর জন্য খরচ হচ্ছে। রিয়েল এস্টেটে নয়। রিয়েলে এস্টেটে তোলাবাজি হয়। ঘটনা হল এগুলি লোক দেখানো খরচ। এবং এগুলি অর্থনীতিতে ঋণাত্মক ছাপ ফেলছে।

শেষ যে জিনিসটা বলার সেটা হল, প্রত্যেকটা জেলায় তৃণমূল নেতাদের ছত্রছায়ায় অজস্র দুষ্কৃতী এবং মাফিয়া রয়েছে। যারা নির্মাণ থেকে শুরু করে সব জায়গায় থেকে টাকা তুলছে। এমনকি বিয়ে বাড়িতে থেকেও তারা টাকা তুলছে। জোর যার মুলুক তার- এই নীতিতে চলছে বাংলা। আর তাই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আর তাই বিজেপি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইছে। তবে প্রশ্ন হল কীভাবে তারা সেই কাজ করবে? নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ বাংলায় আসতেই পারেন, কি কি করতে চান সে ব্যাপারে বলতেই পারেন। দিল্লির কী উন্নয়ন করেছেন তা জানাতে পারেন। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি একটু আলাদা। বাংলায় একটা বড়সড় শূন্যস্থান রয়েছে। তবে বিজেপির কোনও নেতা 'মুখ' হিসেবে উঠে আসেননি। যদিও বিভিন্ন জেলায় বিজেপি বেশ ভাল কাজ করছে, লড়াই দিচ্ছে শাসকদলকে। তবে এখনকার বিজেপির অনেকেই তৃণমূল থেকে এসেছেন। একই রকম ভাবে দুষ্কৃতীরাও তৃণমূল থেকে যোগ দিচ্ছে বিজেপিতে। তাই প্রশ্ন হল বাংলার কী পরিবর্তন হবে যেখানে কোন রাজ্য স্তরের নেতা নেই? অন্যদিকে রয়েছেন মমতা। তৃণমূলের এক নেত্রী যাঁকে দেখে মানুষ ভোট দেন। তবে কাকে দেখে বিজেপিকে ভোট দেবে মানুষ? মুখ্যমন্ত্রী পদে অনেকেই থাকতে পারেন। কিন্তু কোনও রোল মডেল নেই, যিনি বিজেপির প্রতিনিধি হতে পারেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্লোগান দিয়েছিলেন, 'দিল্লি চলো', 'তুমি আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকের স্বাধীনতা দেব'। কিন্তু এখন সেই মাত্রার কোনও নেতা নেই। এক সময় এক সিপিআইএম নেতা আমাকে বলেছিলেন, আমাদের মমতার মতো কোনও নেতা পার্টিতে নেই। তাই মমতাকে সামলানো আমাদের পক্ষে কঠিন। বিজেপির-ও মমতার মতো কোনও নেতা নেই, এটা সত্যি কথা। তারা সে কারণে একই সমস্যায় পড়েছে। মমতাকে সরানোর জন্য তাদেরও একটা 'মমতা' দরকার। পরিবর্তন স্লোগান হিসেবে খুব ভাল। কিন্তু তার থেকেও বেশি দরকার দরকার এখজন নেতার, যাঁকে মানুষ যাকে ভরসা করতে পারবেন। বিজেপি এই সংকট কাটাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখ ব্যবহার করছে। তবে নরেন্দ্র মোদি কি এই সংকট মেটাতে পারবেন? টিম নরেন্দ্র মোদির তরফ থেকে একথাও বলা হচ্ছে, কেন্দ্রে রাজ্যে যদি একই সরকার থাকে, তাহলে বাংলার অনেক কাজ হবে। বাংলা অনেক উপকার পাবে। বাংলার মানুষের সুবিধা হবে। 

Advertisement

মমতার পাল্টা জবাব হল, কেন্দ্র বাংলাকে বঞ্চনা করছে। আর তাই জন্যে টাকা দিচ্ছে না। উন্নয়নের টাকা দিচ্ছে না। বিজেপি রাজ্য ক্ষমতায় এলে কী বেশি টাকা দেবে? এখন প্রশ্ন হল, পরিবর্তন কে আনবে মানুষ না দল? অন্যদিকে মানুষ কি আরও একটা পরিবর্তনের জন্য তৈরি?

 

Advertisement