মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে ২১ জুলাই একটি ঐতিহাসিক দিন। এই ২১ জুলাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটার পরিচয়পত্রকে বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তার কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সময় মূল অভিযোগ ছিল, সাইন্টিফিক রিগিং মেশিনারি। সিপিএমের বারবার জয়লাভের পেছনে আছে এই রিগিং মেশিনারি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই দিন এক অভিশপ্ত দিনে পরিণত হল পুলিশের ভয়ঙ্কর অত্যাচারে। সেই দিন সাংবাদিক হিসেবে আমিও কোনও দিন ভুলতে পারব না। তার কারণ, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই,রাইটার্স অভিযান হয়েছিল বটে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু রাইটার্স দখল করা বা রাইটার্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে পড়া- এই ধরনের নাটকীয় কোনও রণকৌশল ছিল না। এটা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল রাইটার্স বিল্ডিংয়ে।
বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মিছিল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে উনি ধাবিত হন, তখন কিন্তু তিনি বারবার চিৎকার করে সমস্তকর্মীদের বলেছেন, রাইটার্সের দিকে তাকিও না। রাইটার্সের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁদিকে ঘুরছে, সেইদিকে, অর্থাৎ, হাইকোর্টের দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিলের চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় সিপিএম সাংঘাতিক প্যানিকের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পর্যন্ত ধারণা হয়, বোধহয় ওরা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়বে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিএমের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন এবং পুলিশকে দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপরেই শুরু হয়ে যায় পুলিশের লাঠিচার্জ এবং পুলিশের আক্রমণ। পুলিশের আক্রমণ, গুলিচালনায় সেই ভয়াবহ দিনে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। সেই ১৩ জনের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল রাইটার্স বিল্ডিংয়ের গতিকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন কংগ্রেসে। নরসিমা রাও দেশের প্রধানমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসে থেকে তখনও তৃণমূলকংগ্রেস গঠন করেননি। তার কারণ, তিনি চেয়েছিলেন, কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়তে। আজকে সেই কংগ্রেস আর সিপিএম জোটবদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে তারা মমতার বিরুদ্ধে নির্বাচনী জোট। আর সেই জোট ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সঙ্গে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে নতুন আর একটি দল—তাকে সঙ্গে নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেই সিপিএম আর সেই কংগ্রেস, যে কংগ্রেসে তখন মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়,সেই সিপিএম আর সেই কংগ্রেস আজ জোটবদ্ধ। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিণতি যে,সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের নেত্রী হয়ে এইরকম শহিদ দিবস পালন করেছেন! তিনি যখন তৃণমূল কংগ্রেসে চলে আসেন, তৃণমূল কংগ্রেসই কিন্তু শহিদ দিবস পালন করে।
যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, সেদিন কিন্তু তাঁরা কংগ্রেস কর্মী ছিলেন। কারণ তখন তো তৃণমূল কংগ্রেস গঠন হয়নি। তার ফলে কংগ্রেসেরও দায়িত্বে পড়ে, অন্তত যুব কংগ্রেসের ও তো দায়িত্ব পড়ে, ২১জুলাই —এই দিনটিতে শহিদ দিবসকরা। যেহেতু এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস হয়ে গেছে, সেহেতু কংগ্রেস এই ২১ জুলাইয়ের দিন অস্বস্তিতে ভোগে। তারা ঠিক মতো করে এদিন টা তারা পালন করে না।
এটা মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বাৎসরিক স্মরণ অনুষ্ঠান। এটা তো পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর হচ্ছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেক লোক মারা গেছে। সেই কারণে এটা খুব আনন্দউৎসব, আবিরখেলা—সব জায়গায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারণ করে দিয়েছিলেন।
সেই দিনটার কথা আরও মনে পড়ে এই জন্য যে, আমরা সমস্ত সাংবাদিকরা সেদিন ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আন্দোলনের সাক্ষী। আমরা বারবার দেখতে চেয়েছিলাম,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাইটার্সের ভিতরে মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়েন কিনা। চাইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নাটকটা করতে পারতেন। সেই মুহূর্তে এমন লোকের ভিড় হয়েছিল, যেন মনে হচ্ছে, পিলপিল করে চারদিক থেকে লোক আসছে। এক একটা মোড়ে পুলিশের পিকেটিং ভেঙে দিয়ে মানুষের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।