Hilsa Of North Boroli: সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একটি ইন্টারভিউতে উত্তরবঙ্গের কথায় বোরোলির স্মৃতিচারণ করেছিলেন। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বোরোলির বড় ভক্ত ছিলেন। প্রণববাবুকে এই মাছ রান্না করে খাইয়েছেন রাষ্ট্রপতি ভবনের পাচক। জ্যোতি বসুর উত্তরবঙ্গ সফরে অন্য যে কোনও পদ থাক না থাক, বোরোলি থাকতই। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ও উত্তরবঙ্গ সফরে বোরোলি রাখেন পাতে। তাহলেই বুঝতে পারছেন, এর চাহিদা ও স্বাদ কতটা?এতটাই যে ভালবেসে উত্তরবঙ্গের লোকেরা একে উত্তরের ইলিশ নাম দিয়েছেন। দাম? সেও তো কম নয়! ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি।
এমনিতে সারাবছর মেলে। তবে বর্ষায় এর স্বাভাবিক বিচরণের সময়। এই সময় দাম একটু নেমে আসে কেজি প্রতি ৬০০ টাকার কাছাকাছি। তার নীচে নামতে শেষ ১৫ বছরে কেউ দেখেনি। বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় মাছ যে ইলিশ সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু খাদ্য প্রেমিদের তত্ত্ব তালাশ বলছে এই বাংলাতেই একাধিক মাছ রয়েছে, যা ইলিশকে টেক্কা দিতে পারে। তার মধ্য়ে অন্যতম এই বোরোলি।
উত্তরবঙ্গ মানেই কাঞ্চনজঙ্ঘা, দার্জিলিং, তিস্তা, মহানন্দা, জলদাপাড়া, গরুমারা আর অবশ্যই বোরোলি। ভালবেসে কেউ কেউ তার নাম রেখেছে 'তিস্তার ইলিশ' অনেকে বলেন উত্তরের ইলিশ। আকারে খুব বড় হলে সাড়ে তিন-চার ইঞ্চি। তাতেই মোটামুটি বাঙালির পাতে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে তারা। সর্ষে দিয়ে বোরোলির পাতুরি কিংবা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঝোল। বোরোলির ঝাল কিংবা চচ্চড়ি, যেভাবেই রাঁধুন, মশলার ভিড় থেকে নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতি তুলে ধরতে পটু এই মাছটি।
ভোজনরসিকদের মতে তিস্তার বোরোলির স্বাদ সবচেয়ে বেশি। অবশ্য কেবল তিস্তা নয়, তোর্সা,করলা,রায়ডাক,বালাসন,কালজানিতেও মেলে এটি। তোর্ষার বোরোলিও স্বাদে-গন্ধে দুর্দান্ত। উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছেই এই মাছ পরিচিত ছিল। পাওয়া যেত মূলত জলপাইগুড়ি-কোচবিহার-আলিপুরদুয়ারে। তবে এখন দূষণের কারণে বোরোলি কমে গিয়েছে।
অথচ চাহিদা মারাত্মক। নদীর টলটলে পরিষ্কার প্রবহমান জল ছাড়া বোরোলি বাঁচে না। উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোতে কীটনাশক ব্যবহার বেড়েছে। তা মিশছে নদীর জলে। তাই নদীর দূষণও বাড়ছে। তাই সংখ্যা কমেছে। এমনিতে বোরোলি মেলার কথা বর্ষার ঠিক আগে এপ্রিল-মে নাগাদ অথবা বর্ষার পরে অক্টোবর-নভেম্বরে। যখন নদীর জল কমে আসে। দশ বছর আগেও এই দুই সময়ে মোটামুটি ভাবে বাজারে বোরোলি ভালই উঠত। কিন্তু ‘এখন বোরোলির পরিমাণ তার চেয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
বোরোলির অক্সিজেন বেশি লাগে। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর জলে সেই অক্সিজেন পায় ওরা। তাই কেবল ওই ধরনের নদীতেই বোরোলি মেলে। তাঁর বক্তব্য, তিস্তায় ব্যারাজ হওয়ার ফলে স্রোত কমেছে। বোরোলিও কমেছে। কিন্তু তোর্ষায় কোনও ব্যারাজ নেই, তাই এখন তুলনামূলকভাবে বোরোলি সেখানেই বেশি পাওয়া যায়।
সেই সঙ্গে প্রাণিবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, ইলিশের মতোই বোরোলিরও স্বভাব হল ঝাঁক বেঁধে স্রোতের বিরুদ্ধে গা ভাসিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া। তা ব্যাহত হলেও বোরোলি মুখ ফিরিয়ে নেয়। উত্তরের নদীগুলির স্রোতের স্বাভাবিক গতিও এখন অনেক কম। সব মিলিয়ে বোরোলি নিয়ে উদ্বেগে পরিবেশপ্রেমীরা।
ইতিমধ্যেই বোরোলি ফেরাতে নানা বিকল্প চাষের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তবে বোরোলিপ্রেমীরা খেয়ে বলেছেন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ব্যাপার। কোনও বিকল্পই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না স্বাদের নিরিখে। বড়োজোর ওই সব মাছকে বোরোলির আত্মীয় বলা যেতে পারে। তবে আসল বোরোলির স্বাদই আলাদা। আর সে স্বাদের কোনও ভাগ হবে না।