কালিম্পংয়ের মরগ্যান হাউস। অ্যাডভেঞ্চারাস টুরিস্টদের জন্য নামটা শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখনও নাকি সেখানে মরগ্যান সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর ভূতকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন। রাতে উদ্ভট আওয়াজও শোনেন বলে দাবি করেন। অনেকে আবার কয়েক রাত কাটিয়ে জানান তাঁরা কিছুই দেখেননি।
কারও মতে সারারাত দুমদাম আওয়াজ হয়। কে যেন কাঁদে। কেউ নাম ধরে ডাকে মাঝরাতে। আবার কারও মতে বাথরুমে জলের কল নিজেই খোলে নিজেই বন্ধ হয়। আবার রাতে বাথরুমে গেলে লাইট নিভে যায়। পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু কালিম্পংয়ের মর্গ্যান হাউস।
প্রতি বছর পর্যটন মরশুমে এখানে ফাঁকা পাওয়া মুশকিল। অনেকে আগাম বুকিং না করেও চলে যান সেখানে। তারপর ঘর না পেয়ে মন খারাপ করেন। তাই পর্যটন উন্নয়ন পর্ষদের তরফ থেকে মরগ্যান হাউসের পাশে ছোট ছোট কটেজ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। অন্তত আরও বেশি কিছু লোককে সেখানে যায়গা করে দেওয়ার জন্য। তাতে খুশি পর্যটকরাও। রাজস্ব বৃদ্ধিতে খুশি পর্যটন দফতরও। এই মুহূর্তে ভরা মর্গান হাউস।
তবে শুধু ভূতের ভয়ই এখানকার ইউএসপি, তা নয় কিন্তু। ব্রিটিশ স্থাপত্যে তৈরি কান্ট্রিসাইড বাংলোর আদলে তৈরি এই বাংলো একেবারে সাহেবি আমেজ। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে পোড়োবাড়ি। আসলে, ভিতরটা ঝাঁ চকচকে করলেও বাইরের চেহারাটা ইচ্ছে করেই বদলানোর চেষ্টা হয়নি। পুরনো আকর্ষণ বজায় রাখতেই তা করা হয়েছে।
ভিনটেজ এই বাংলোর ভিতরের সিঁড়ি থেকে মেঝে, সবই কাঠের। ঘরের আকার ছোটখাটো ফুটবল মাঠের মতো। ভাড়াও এখানে সাধ্যের মধ্যেই। ১৮০০ থেকে ২১০০ টাকার ঘরগুলো আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয়। ঘরের মধ্যেই যেন এসে ঢুকে পড়ে মেঘ। সারা বছরই শিরশিরে ঠান্ডা। আর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হাড় হিম ঠান্ডা।
এই এলাকাটা কিন্তু সেনাবাহিনীর এলাকার মধ্যে পড়ে। ফলে যানজট কম। ভবনের বাইরেই বিরাট এক গল্ফ কোর্স। এটাও মরগ্য়ান সাহেবের বানানো। এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কত ছবির শুটিং যে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেনাবাহিনীর একটা সুন্দর সাজানো ক্যান্টিন রয়েছে। সেখানে যে কেউ খেতে যেতে পারেন।
কেউ যদি ভূতে বিশ্বাস নাও করেন, তাহলেও মর্গান হাউস এর ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারবেন না। ইতিহাস! তাও তো গা ছমছমে। এই ভবনটি তৈরি করা হয়েছে ১৯৩০ সালে। এক নীলকর সাহেবের মেয়ের সঙ্গে সেই সময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাটের ব্যবসায়ী জর্জ মরগানের বিয়ের অনুষ্ঠানের স্মৃতিতে তৈরি করা হয়েছিল।
তারা বেঁচে থাকতে বিভিন্ন সময়ে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের বিয়ের অনুষ্ঠান এবং পার্টির জন্য ব্যবহার করতেন তাঁরা। পরে মিঃ এবং মিসেস মর্গান মারা যাওয়ার পর বাড়িটি এমনিই পড়েছিল হন্টেড হাউসের মতোই। পরে স্বাধীনতার পর বাড়িটির মালিকানা ভারত সরকারের হাতে চলে আসে।
১৯৬২ সালে জহরলাল নেহেরু যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন এটিকে সরকারি রেস্ট হাউজের পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তারপরই হঠাৎ নেহেরু মারা যাওয়ার পর এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া হয়। ১৯৬৫ সালে এটি কেন্দ্রীয় পর্যটন দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
আরও বছর দশের পর ১৯৭৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন এর হাতে তুলে দেওয়া হয় মরগ্যান হাউস। এখনও পশ্চিমবঙ্গ ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনই বাড়িটির মালিকানায়। সম্প্রতি পাঁচ বছর আগে এটিকে সর্বশেষ সংষ্কার করা হয়েছে। তবে আদলে কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।
শুধু কি সাধারণ পর্যটক! বাঙালি বিভিন্ন তারকাদের পছন্দের জায়গা ছিল এটি। উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া, কিশোর কুমার, অমিত কুমার, লীনা চন্দ্রভরকার, সুনীল দত্ত, নার্গিস, ওম প্রকাশরা কোনও একটি সিনেমার শুটিংয়ের সময় এখানে দীর্ঘ কয়েকমাস ঘাঁটি গেড়েছিলেন। উৎপল দত্তের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল এটি। তিনি মাঝেমধ্যেই এখানে আসতেন। এসবই এখানকার রেজিস্ট্রারে তুলে ধরা আছে।
অপূর্ব সুন্দর, এই বাগানঘেরা বাড়িটি আইভি-লতা ও উইস্টেরিয়া দিয়ে জড়ানো। এই বাড়িটি যেন স্বপ্নের জগতের এক ঠিকানা। অসাধারণ অবস্থান, অপূর্ব সাজসজ্জা, আর বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা আপনাকে সুখানুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। এ ছাড়াও আশেপাশে আছে বৌদ্ধ গুম্ফা, এবং কালিম্পঙের বিখ্যাত নার্সারি। আছে গ্লেনারিজের ফ্রুট কেক, একদম গরম গরম। শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, দূষণ থেকে অনেক দূরে এখানকার শান্ত স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে স্বর্গের অনুভূতি দেবে।
এখানকার ঘরগুলির অন্দরের সজ্জাতেও অভিভূত হতে হয়। সুগন্ধি, ধূমায়িত চা আপনাকে মোহিত করে দেবে। প্রাতঃরাশ এখানে কমপ্লিমেন্টারি। খাবারও খুব একটা দামি নয়। বাগডোগরা বিমানবন্দর কিংবা এনেজেপি স্টেশন থেকে কয়েক হাজার গাড়িতে শুধু মরগ্যান হাউস বলে চেপে পড়লেই কেল্লাফতে। একদম হাুউসের দোরগোড়ায় গিয়ে নামবেন। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে পর্যটক টানতে কয়েকমাসের ধুলো ঝাড়পোঁছ করে প্রস্তুত বলে জানান এখানকার কর্মী শুভঙ্কর সরকার।