ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসার মাস বলা হয়। ভালোবাসা এবং প্রেমের গল্পগুলি এই ভালোবাসার সপ্তাহে আরও বেশি করে লাইম লাইটে চলে আসে। বেশির ভাগ প্রেমের গল্পে সুখী সমাপ্তি ঘটবে এমনটাই আমরা ভাবি, কিছু বিরহও থাকে প্রেমের গল্পে। পাকিস্তানের কায়দ-ই-আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং এক পারসি কন্যা রতন বাইয়ের প্রেমের গল্পটিতে রয়েছে করুণ সুর।
মুম্বাইয়ের সবথেকে বড় ধনীদের মধ্যে একজন স্যার দিনশা পেটিট সকালের জলখাবার খেতে বসেছিলেন। খাবার টেবিলে বসেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিজের প্রিয় খবরের কাগজ 'বম্বে ক্রনিক্যাল'। খবরের কাগজে আটের পাতায় পৌঁছে একটা খবরে চোখ যেতেই কাগজটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। তারিখটা ছিল ২০শে এপ্রিল, ১৯১৮। সংবাদটা ছিল স্যার দিনশার কন্যা লেডি রতিকে আগের দিন সন্ধ্যায় বিয়ে করেছেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
লেডি রতির পুরো নাম ছিল রতনবাই পেটিট। ঘটনার শুরুটা হয়েছিল আরও বছর দুয়েক আগে। স্যার দিনশা নিজের বন্ধু আর ব্যারিস্টার মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে দিনশার ১৬ বছরের কন্যা লেডি রতিও ছিলেন। সেই সময়ের মুম্বাইয়ে মিস রতির সৌন্দর্য রীতিমতো চর্চার বিষয় ছিল। আর জিন্নাহ তখন ভারতীয় রাজনীতির শিখরের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন।
মি: জিন্নাহর বয়স তখন প্রায় ৪০। কিন্তু দার্জিলিংয়ের বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া আর নৈ:শব্দ এমনই যাদু দেখালো যে লেডি রতি ও জিন্নাহ একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলেন। দার্জিলিং ভ্রমণের সময়েই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্যার দিনশা পেটিটের কাছে তার কন্যার পাণি প্রার্থনা করেন, প্রস্তাব দেন তার মেয়েকে বিয়ে করার।
'মিস্টার এন্ড মিসেস জিন্নাহ - দা ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া' [মি: ও মিসেস জিন্নাহ - যে বিবাহ ভারত কাঁপিয়ে দিয়েছিল] বইটির লেখিকা শীলা রেড্ডির কথায়, 'দার্জিলিংয়েই একদিন নৈশাহারের সময়ে জিন্নাহ প্রশ্ন করেছিলেন দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহ নিয়ে স্যার দিনশার কী মতামত।' সঙ্গে সঙ্গেই মিস রতি'র বাবা উত্তর দিয়েছিলেন যে দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহসূত্রে মেলবন্ধন হলে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করতে সুবিধাই হবে। এর থেকে পছন্দের উত্তর স্বয়ং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও বোধহয় দিতে পারতেন না।
তাই মুহুর্তের মধ্যে জিন্নাহ ফের মুখ খুললেন, স্যার দিনশাকে জানালেন যে তিনি তার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। তবে এই প্রস্তাবে সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন স্যার দিনশা। উত্তেজনা এতটাই ছিল যে অতিথিকে সেই মুহুর্তে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন তিনি। জিন্নাহ অনেক চেষ্টা করেও স্যার দিনশার মত বদলাতে পারেননি। দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হলে যে বন্ধুত্ব আর ঐক্য দৃঢ় হবে, স্যার দিনশার ওই তত্ত্ব প্রথম পরীক্ষাতেই ব্যর্থ হয়ে গেল।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে কথা বলেননি স্যার দিনশা। আর মেয়ে লেডি রতির ওপরেও নির্দেশ জারি হলো- যতদিন তিনি দিনশার বাড়িতে আছেন, ততদিন জিন্নাহর সঙ্গে কোনোভাবে দেখা করতে পারবেন না। সেখানেই শেষ নয়। কোর্ট থেকেও আদেশ বের করালেন স্যার দিনশা যেন লেডি রতি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত জিন্নাহ যাতে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা না করতে পারেন। এত কিছু করেও রতি আর জিন্নাহর লুকিয়ে দেখা করা বা একে অন্যকে চিঠি লেখা থামাতে পারেননি স্যার দিনশা পেটিট।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আরেক জীবনীকার অধ্যাপক শারিফ আল মুজাহিদ বলছেন, '১৯১৮ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি লেডি রতি ১৮-তে পা দিলেন। আর সেদিনই একটা ছাতা আর এক জোড়া পোষাক নিয়ে পিতৃগৃহ ত্যাগ করলেন তিনি।' রতিকে জামিয়া মসজিদে নিয়ে গেলেন জিন্নাহ। ইসলাম ধর্মান্তরিত করে পরের দিন, ১৮ই এপ্রিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর লেডি রতির নিকাহ সম্পন্ন হলো। মিস রতি ও মি: জিন্নাহ-কে নিয়ে একটি বইয়ের লেখক খওয়াজা রাজি হায়দার বলছেন, 'জিন্নাহ তখন ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যদি তিনি সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করতেন, তাহলে সম্ভবত তাকে কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করতে হতো। সেজন্যই তিনি ইসলামী মতে বিয়ে করেছিলেন আর রতিও রাজি হয়েছিলেন এতে।'
নিকাহনামায় ১০০১ টাকা মোহরের উল্লেখ ছিল, কিন্তু জিন্নাহ রতিকে উপহার দিলেন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। সেসময়ে সেটা বিশাল অঙ্কের টাকা। ২৪ বছরের ছোট একটি মেয়ের সঙ্গে জিন্নাহর বিবাহ সেই সময়ে ভারতীয় সমাজের এক নম্বর গসিপে পরিণত হয়েছিল। সামাজিক আলোড়নও ফেলেছিল সেই ঘটনা।
১৯১৮ সালের সেই বসন্তে জিন্নাহ আর রতির উচ্ছল, খুশীতে ভরপুর চেহারা দেখেই মনে হতো যে এরা একে অন্যের জন্যই যেন তৈরি হয়েছেন, হিন্দিতে যাকে বলে 'এক দুসরে কে লিয়ে হি বনে'! রতির অপূর্ব সুন্দর শরীরে ঝলমল করতো নীল বা গোলাপি রঙের পোষাক, কখনও তাতে থাকতো সোনালী কারুকাজ। রূপা আর মার্বেল পাথরের তৈরি সিগারেট হোল্ডারে গোঁজা বিদেশী সিগারেটের ধোঁয়া যখন ছাড়তেন রতি, তখন তার ব্যক্তিত্ব আলাদা মাত্রা পেত।
তার চলাফেরা, আদবকায়দা তো চোখে পড়ার মতোই ছিল, কিন্তু চারপাশের মানুষের কাছে সবথেকে আকর্ষণীয় হয়ে উঠত তার হাসি। তবে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যস্ততা আর স্ত্রীর সঙ্গে বয়সের ফারাক জিন্নাহ আর রতির মধ্যে ধীরে ধীরে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে দিল। তখন অল্পবয়সী স্ত্রী আর দুধের শিশুকন্যার জন্য দেওয়ার মতো সময় তার হাতে বিশেষ ছিল না।
জিন্নাহর একসময়কার সচিব এম সি চাগলা, যিনি পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'আমি আর জিন্নাহ যখন কোনো আইনী বিষয়ে আলোচনা করতাম, তখন কয়েক সময়ে রতি একটু বেশিই সাজগোজ করে চলে আসতেন আর জিন্নাহর টেবিলের ওপরে উঠে বসে পা দোলাতেন। মনে হতো যেন কখন জিন্নাহ কথাবার্তা শেষ করে তাকে নিয়ে বাইরে বের হবেন।'
রাজি হায়দার অবশ্য মনে করেন যে দুজনের মধ্যে একটা হাল্কা দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণটা ছিল রাজনৈতিক। ১৯২৬ সাল নাগাদ ভারতের রাজনীতিতে জিন্নাহর যে অবস্থান ছিল, সেটা ১৯১৬সালে তাদের বিয়ের সময়ের থেকে অনেক উঁচুতে। আর এই কতগুলো বছরে জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেছেন। অন্যদিকে লেডি রতিও মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
একবার অসুস্থতার পরে ফ্রান্স থেকে এম এস রাজপুতানা নামের জাহাজে চেপে দেশে ফেরার সময়ে স্বামীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন রতি। তাতে রতি জিন্নাহ লিখেছিলেন, 'আমার জন্য তুমি যা করেছ, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি তোমাকে যতটা চেয়েছিলাম, আর কোনো পুরুষমানুষকেই কোনো নারী বোধহয় অতটা চায় নি কখনও। তুমি আমাকে ওই ফুলটার মতো করেই মনে রেখ যেটা ছিঁড়ে এনেছিলে। যে ফুলটাকে তুমি পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছ, সেটাকে মনে রাখার দরকার নেই। '
১৯২৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী, মাত্র ২৯ বছর বয়সে রতি জিন্নাহ মারা যান। শেষ সময়টায় তার সঙ্গী ছিলেন কাঞ্জি দ্বারকা দাস। শীলা রেড্ডি লিখছেন, 'কাঞ্চিই জানিয়েছিলেন যে শেষ দিনগুলোয় রতি খুব মনমরা হয়ে থাকতেন। একবার কাঞ্জি রতিকে বলেছিলেন তার আসতে একটু দেরী হবে। শুকনো মুখে রতি জবাব দিয়েছিলেন, 'ততক্ষণ অবধি যদি বেঁচে থাকি'। পরে কাঞ্জিই এক পাকিস্তানি সাংবাদিককে বলেছিলেন অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন রতি। এই অসম যুগলের প্রেমের পরিণতি শুভ হয়নি। বিয়ে-পরবর্তী অশান্তি এবং শেষমেশ মাত্র ২৯ বছর বয়সে রটির অকাল মৃত্যু। রটির মৃত্যুতে জিন্নাহ নিজের দোষ খুঁজে পেয়েছিলেন। ভেঙেও পড়েছিলেন বলে জানা যায়।