মানুষ তো কিছুটা গোপন-বন্দী। বেশ কিছু ভাবা-টাবা মানুষ নিজের কাছেই রাখে। ওসব ভাবনা নিয়ে মন আলুথালু হয়, খুঁতখুঁত করে, উচাটন হয়, আনচান করে কিন্তু সেসব বাইরে আনা যায় না। সেসব মনের মধ্যেই বুদবুদ হয়ে ফুটে ওঠে, আবার সেই মনের কোণেই হারায় সেসব। সময়ে আবার সেই চিন্তা, সেই উদ্বেগ, সেই ভালোবাসা মনের মধ্যে ধাক্কা দেয়। এসব চলতে থাকে অবিরাম কিন্তু তা বাইরে আনা যায় না। কার ভাবনা কেন বাইরে আনা যায় না, কেনই বা একান্তে ভাবনা বা ধারণা বা চিন্তা মনেই ধারণ করে যেতে হয়, সেটি যার মন সেই জানে।
ওটা আসলে মনের পতাকা।
ওটা মনের মধ্যেই ওড়ে, মনের মধ্যেই অস্ত যায় আবার কোনও এক সন্ধিক্ষণে মনের মধ্যেই পতপত করে ভেসে ওঠে। এই পতাকাটার রঙ, রূপ, ঐশ্বর্য সব মনের ভিতরের সম্পদ। তবে সেসব গোপন। প্রকাশ্যে আনার বিষয় নয়, তাই অনেকেই এমন অনেক কিছু প্রকাশ্যে আনেন না।
ওই পতাকাটা যার, একান্তই তার। তিনি ওড়ান, তিনিই নামান।
অথচ পতাকা মানেই উজ্জ্বল তার প্রদর্শন। সেটি খুঁটিতে উড়বে, ফুল ছড়াবে, হাওয়ায় খিলখিল করে হাসবে, পাঁচজনের স্যালুট পাবে আবার সাঁঝ সন্ধ্যেয় পতাকা দণ্ডে মুড়ে থেকে বিশ্রাম নিয়েই সকালের আলোয় উপরে উড়ে উড়ে ভাসবে। এই তো পতাকা। সেরকমই তো দেখে এসেছি সেই ছোট্টোবেলার স্মৃতি থেকে। আমি যা দেখেছি সব ছোটোরাই তাই দেখেছে। 'কদম কদম বাঢ়ায়ে যা'র সাথে যখন পায়ে পা মিলিয়েছি তখন থেকেই হাতে পতাকাটা উঠেছে। ছোট্টো কাঠিতে আঠা মুড়ে দেওয়া পতাকাটা কেমন স্বাধীন স্বাধীন ভাব এনেছে মনে। লাউড স্পীকারে গান ভেসে এসেছে, পতাকা থেকে ফুল গড়িয়ে পড়েছে, আঙ্গুল জোড়া করে স্যালুট দিয়েছি, জাতীয় সঙ্গীতের মুর্ছনায় গলা ছেড়ে গলা মিলিয়েছি, ব্যাস পতাকার গাম্ভীর্য, ভালোবাসা মনে গেঁথে গেছে।
আর শুধু কি তাই ? মোটেই না।
পতাকা মানে তো শুধু দেশ নয়, দেশপ্রেম নয়, পতাকা আরও নানা ভাবে শরীর আর মনজুড়ে রয়ে গেছে। ওটা আসলে এক ধরণের স্বাতন্ত্র্যবোধ। নিজেকে চিনিয়ে দেওয়া বা প্রচারের চিহ্ন হয়েও পতাকা বেশ সহায়ক হয়ে গেছে। পতাকা তো আসলে দর্প। যে বাস্তবতা বা যে ভাবালুতা মন জুড়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বয়ে গেছে সেই দলের পতাকা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতেও ওই একখন্ড কাপড় বা কাগজ বড় কাজে লেগেছে। ওটা হয়তো দম্ভ, ওটা হয়তো প্রেম, ওটা হয়তো জাহির বা ওটা ব্যক্তিত্বের স্মারক হয়েই নিজের সাথে পথ চলেছে। পথ চলতে চলতে চলতে ওটাই পরিচয় হয়ে রয়ে গেছে।
পতাকা এমনই। যে যেমন ভাবে ঘোরে তার পতাকাও তেমন ভাবে ওড়ে।
সেদিন ওই লোকটা চলে যাওয়ার আগে আবডালে কবির মতো বলে গেলো- 'পড়বে না মোর চরণ চিহ্ন এই বাটে'। এর বেশি লোকটা আর কিছু বলেনি। ওটি বলেই চুপ করে গেলো। নিশ্চুপ। তখন দেখলাম আশেপাশের সবাইও নিশ্চুপ হয়ে গেলো। খালি কিছু লোক একটা পতাকা নিয়ে এলো। সেই পতাকায় মুড়ে লোকটির নশ্বর শরীর চললো শেষ যাত্রায়। লোকটি আর জানেনা সে কোথায় যাচ্ছে, কেনই বা যাচ্ছে, শুধু আশেপাশের লোকেরা জানে সে যাচ্ছে মানে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে জানাতে পতাকাও যাচ্ছে। কতো লোক ওই শেষবারের মতো চলে যাওয়া লোকটাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে আর সেই শ্রদ্ধার আলো ঠিকরে পড়ছে ওই মুড়ে দেওয়া পতাকায়। লোকটা চলে গেলো, পুড়ে শেষ হয়ে গেলো তবে তার মুড়ে দেওয়া পতাকাটা রয়ে গেলো। পতাকাতো পোড়ে না, পতাকা ওড়ে। পতপত করে উড়তেই তো পতাকা, পতাকা হয়ে থাকে ভাস্বর হয়ে।
শুধু কি তাই ? পতাকার আবাধ বিচরণ মাঠেও। ওই যে ছেলেগুলো মাঠের দিকে দৌড়োচ্ছে, ওদের হাতে পতপত করে উড়ছে পতাকা। ওরা জিততে দৌড়োচ্ছে। ওদের দল যখন গোল করছে, ওরা পতাকা ওড়াচ্ছে। আমার দেশ যখন পদক পাচ্ছে, তখন আমাদের পতাকা বিশ্বজুড়ে শোভা পাচ্ছে। পতাকার মহিমায় দেশ আনন্দে ভাসছে। তাই পতাকার কোনো বিকল্প হয়না, সে রঙ ছড়িয়ে নিজেই রঙিন, আবিরের মতো ওড়ে, বীরের মতো শির উঁচু করে থাকে।
সবার উপরে।
ধর্মের পতাকাটা আবার একটু যেন ধ্বজা টাইপের। কখনও ওই পতাকা পাশাপাশি ওরে, কখনও দূরে দূরে। তবুও নিজের পতাকাটা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ওটি জন্মসূত্রে পাওয়া পতাকা তো তাই যুক্তি, অযুক্তি পেরিয়ে ওটা লেপটে থাকে জন্ম ইস্তক। কেউ সেটি ওড়ায় আড়ম্বরে, কেউ গুটিয়ে রাখে। কিন্তু হিন্দু বাঙালি সাধারণতঃ একটি ধর্মীয় পতাকা গোপনে ধরে রাখে। ওটাই আবার তার ভালোবাসা, আড়ম্বরও। তখন সে তার গোপন পতাকাটিও উড়িয়ে দেয় বাইরে। সেটির প্রকাশে তখন তার অনাবিল আনন্দ। সেটি উৎসব। সেটি কিন্তু তার আদর করে লালনের ছ'টা।
শারদোৎসব।
তখন আর কিছুই গোপন নয়, ওটি উড়িয়ে দেওয়ার পতাকা। তবে হ্যাঁ, সেটি যে শুধু ধর্মের সারাৎসার নিয়ে ওড়ে, বোধহয় পুরোটা তা নয়। ওটি ঋতুর উদযাপন। শরৎ এলে দুগ্গা আসে, না দুগ্গা এলে শরৎ আসে, তাই বা কে জানে ! তারা আসে একসাথে, একযোগে বিহ্বলতার আবহে। এই আবহটাও একটা পতাকা।
তখন দেখেছি,কোথা থেকে কে জানে প্রেম আসে অনেকের মনের দু কূল বেয়ে। আসলে তখন ওই যে গোপন কোনে রাখা উষ্ণ প্রেমটা ছটপট করছিল এতোদিন ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চের পতাকা উড়িয়ে, পুষে রাখা যে ভালোলাগাটা উথলে উঠেছিল, সেটি তখন প্রেয়সীর দিকে হাত বাড়ায়। আর প্রেয়সী বাড়ায় তার হাত তার মনের মানুষের দিকে। ওই শরতে, ওই পুজোতে বহু ভিড়ের আঙিনায় চোখের মণির মতো ভালোবাসার পাত্রকে, পাত্রীকে একবার মনের কথা বলার জন্য, মনের পতাকার উথাল পাতাল বোঝাবার জন্য এক আকুলি বিকুলি চাহিদা ছটপট করে। যৌবনের এই পতাকার উন্মাদনা গোপনতা ভেঙ্গে চোখে চোখ রাখে আর চোখের চাহনিতে তখন একটা পতাকা ওড়ে, হয়তো সত্যিই সত্যিই তখন হৃদয়ে হৃদয় মেলে। গোপনে আরাধ্য পতাকাটি গোপনতা ভেঙে বেরিয়ে উড়িয়ে দেয় ভালোবাসার পতাকা। দুর্গাপুজোর আলোর ঝলকানিতে ওরা হাত ধরে আর মন ধরে ঘুরে বেড়ায়। দুটো মনের দুটো পতাকা একটা লাঠিতেই উড়তে থাকে।
ওটা ভালোবাসার পতাকা।
তবুও তো ভালোবাসার ওই বাসনার পতাকাটাতে কখনও বা চিড়ও ধরে আগামীতে। কার গোপনে কী থাকে একজন হয়তো বোঝে, আরেকজন বোঝে না। তখনও নিভু নিভু আগুনে চোখের পাতায় নেশা জেগে থাকে অবুঝ মানুষটির। অবুঝ মানুষটির ওই হারানো ভালোবাসার নেশাটা জীবনের সম্পাদ্যে কেন না জানি আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। কিছুতেই তার মন মানে না। সে খুঁজে বেড়ায় হারানো প্রেমের কারণ। চোখের কোন চিকচিক করে কিন্তু তবু সে আসে না। যে চলে যায়, সে চলেই যায়। চলে যাওয়ার স্মৃতিটা তখন মনের পতাকায় দাগ রেখে যায়। গোপনে সে দাগ পতাকাটাতে আঁচড় ফেলে।
পুজো আসে, পুজো যায় আর আঁচড়গুলো ভিতরে ভিতরে মন ক্ষতবিক্ষত করে। ওই গোপন বেদনার পতাকা আবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মনের গোপন ক্ষতস্হানে গিয়ে হয়তো বা সেঁধিয়েও যায়। তবু বারবার শরৎ আসে, পুজো আসে, পুজো হয়, পতাকাটা আবার তখন হিল্লোল তোলে মনের গহীন কোনে বড় জোরালো হয়ে। স্মৃতির চোখ তখন এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়।
এতো আনন্দের সাগরে আর পাঁচজনের পুজোর পতাকাটা তখন উড়তে থাকে পতপত করে। শুধু হেরে গেছে ভেবে কেউ কেউ গোপনে নিজের মনে আর একটা পতাকা পুঁতে স্মৃতি আর হারানো দিনের ঢেউ তুলে বেঁচে থাকে। গোপন কষ্ট গোপনেই বুদবুদ হয়ে মিশে যায় তার মনে গুছিয়ে রাখা গোপন পতাকায়।
সব পতাকার রঙ তাই এক নয়। যার পতাকা তাকেই বয়ে যেতে হয়। আড়ালে আর সংগোপনে।
মানুষ কিছুটা গোপন-বন্দী।
(মতামত লেখকের একান্তই নিজের, আজতক বাংলা এর দায়ভার নেবে না)