মানুষ অভ্যাসের দাস (এই দাস পদবি নয়) । কিছুটা লোভীও বটে ! যা পায়, তার থেকে বেশি চায় । আবার চাহিদা মিটতে না মিটতেই নতুন কিছু পাওয়ার আশা । আমিও আলাদা নই বইকি । নতুন বছরে গুচ্ছেরখানা জিনিসপত্র চেয়ে বসেছিলাম (মনে মনে) । আর প্রাপ্তি ?
লকডাউন কাটিয়ে গত বছরের একদম শেষে এসেছি নয়ডা । প্রথম কটা দিন কাটিয়েছি অফিসের গেস্ট হাউজ়েই । এরপর বাড়ি খোঁজার পালা । গত বছরের একদম শেষে পেলাম মনের মতো বাড়ি (ভাড়াটা অবশ্য মনের মতো নয়) । চুক্তি মতো নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনেই বাড়িতে প্রবেশ । নতুন বাড়িতে (ভাড়া) আমার প্রথম রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাই প্রথমে শেয়ার করা যাক ।
সকালে ব্যাগ-পত্র রেখেই চলে গেছিলাম অফিস । তখন ঠান্ডাটা বুঝিনি । রাত দেড়টা নাগাদ বাড়ি ফিরেছি । না আছে কম্বল, না আছে মাথার বালিশ । এদিকে, সেদিন নয়ডার তাপমাত্রা নয় নয় করে 6-7 ডিগ্রির আশপাশে । ভরসা, আগেই কিনে রাখা একটা খাট ও বাড়ি থেকে পাঠানো কয়েকটি চাদর (গোছানো ব্ল্যাঙ্কেট আনতেই ভুলে গেছিলাম) । কোনওভাবে রাত কাটল এভাবেই । ঘুম তো হয়নি, উল্টে ঠান্ডাও লেগেছে বেশ । পরদিন সকালেই অফিসের সতীর্থকে ফোন । সেই লেপ ব্যবস্থা করে দিল । আপাতত কিছুদিনের রেহাই ।
১৪ জানুয়ারি । অগোছালো ঘর থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম দিল্লি স্টেশনের উদ্দেশ্যে । মানালী (আমার স্ত্রী) আসছে । ওকে রিসিভ করে নিয়ে এলাম বাড়ি । বাড়ি ফিরেছি দুপুর আড়াইটে নাগাদ । আগেভাগেই ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম । যদি ট্রেন লেট করে ! ঠিক তাই, মানালীর রাজধানী (রাজধানী এক্সপ্রেস) মাত্র ২ ঘণ্টা লেট ।
মানালী আসার পর থেকে বছরটা আসলেই কাটতে শুরু করল । বিয়ের পর এই প্রথম একসঙ্গে বাইরে কাটানো । নতুন দায়িত্ব, চোখ-ভরা কিছু স্বপ্ন আর অনেকটা চাওয়া-পাওয়ার আশা ।
বছরটা টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেখছিলাম । সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব মেলাচ্ছিলাম । ব্যর্থতার দিকে যেই পাল্লা ভারী হচ্ছে, তখনই চোখের সামনে সাফল্য ধরা দিচ্ছে । কেন জানি না, বারবার মনে হচ্ছে এই বছরটা আমার জন্য অনেকটাই সফল ।
নয়ডার ‘শূন্য’ ভাড়াবাড়ি আজ পরিপূর্ণ । চলতি বছরেই আমরা দু’জনে কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে কিনতে পেরেছি ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, পেল্লায় সোফা আরও কত কী ! ব্যর্থতার তালিকা কি নেই ? হ্যাঁ অবশ্যই আছে । স্বপ্ন ছিল, এই বছরেই একটা AC কিনে ফেলব । পারিনি । গরমে বাবা-মা এসেছিল নয়ডায় । ইচ্ছে ছিল কত জায়গা ঘোরানোর । পারিনি । দায় ? কিছুটা গরম অনেকটা মধ্যবিত্তের মানসিকতার । সব সমস্যা ঝেড়ে ফেলে সেপ্টেম্বর নাগাদ ভাবলাম, বাবা-মাকে নিয়ে বেরোবোই । কোথায় কী ? বাধ সাধল বাবার অসুস্থতা ।
বছরভর একটা বড় জিনিস শিখতে পেরেছি । পারিনি আর পেরেছি’র মাঝে একটাই পার্থক্য, মানসিকতার । তুমি যদি চাও, পারিনিকেও পেরেছিতে বদলাতে পারো । কিছু ক্ষেত্রে এই ফর্মুলায় আমিও সাফল্য পেয়েছি । যেমন - জুনের ঋষিকেশ-হরিদ্বার ট্যুর ।
সত্যি বলতে কী, পাহাড়ে আমার ভীষণ ভয় । এর আগে কোনওদিন যাইনি । তবু, মনে মনে ভয় নিয়েই বড় হয়েছি । সমুদ্রে আমি অনেক স্বচ্ছল । কিন্তু, পাহাড় ? ওরে বাবা রে । পা ফস্কালেই…
ভয় নিয়েই ছুটেছিলাম পাহাড়ে । সঙ্গে ছিল মানালী (ও আবার এক্সপার্ট) ও অফিসেরই চার সতীর্থ । নিরাশ হইনি । আদতে পাহাড় আমায় নিরাশ করেনি । পাহাড় থেকে নিচে তাকিয়ে গঙ্গা দেখেছি, গঙ্গার পার থেকে পায়ে হেঁটে অত উঁচু পাহাড়ে উঠেছি । একবারও ভাবিনি, আমি পারব না । বারবার মনকে বুঝিয়েছি, পারতেই হবে । কষ্ট হয়েছে । তবু, পাহাড়ের একটা করে ঢাল অতিক্রম করেছি । শেষ পর্যন্ত ‘পাহাড় জয়’ । পাহাড় জয়ের জেদেই এখন উপর থেকে নিচে তাকাতে ভয় পাই না, মাথাও ঘোরে না ।
ডিসেম্বরের শুরুতেই ছিল এক বন্ধুর বিয়ে । আগ্রাতে বিয়ে হওয়ায় আমার থেকে বেশি উৎসাহী ছিল মানালীই । তবে তাজমহল নয়, ফতেহপুর-সিক্রির কথা উঠতেই ওর মুখে হাসি খেলে যেত । আগ্রা যাব, তাজমহল ঘুরব না তা হয় নাকি ? অতএব বিয়ের দিন সকালেই যাত্রা । এখানেও আমাদের সঙ্গী অফিসের দুই সতীর্থ । সকালে ট্রেন যাত্রার মাধ্যমে আগ্রায় প্রবেশ । একটা গাড়ি বুক করে প্রথমেই ছুটলাম ফতেহপুর-সিক্রির উদ্দেশ্যে । আকবর-যোধার প্রেমকাহিনী শুনে মন ছুঁয়ে গেল । যেখানেই তাকাচ্ছি, খুঁজে ফেলছি ইতিহাস । বইয়ের পাতায় পড়া দেওয়ান-এ-আম, দেওয়ান-এ-খাস তখন আমার হাতের মুঠোয় । মিলিয়ে চলেছি, একের পর এক কাহিনী । মুঠোবন্দী করছি স্মৃতির উদ্দেশ্যে ।
ফতেহপুর-সিক্রি ঘুরে আমরা এলাম তাজমহল । শুধু নিজেরা চাক্ষুস করেছি তা নয়, বাবা-মা-শাশুড়িমাকেও দেখিয়েছি । ভিডিয়ো-কলে একবার অমর-সৃষ্টি দেখতে পেয়ে আমাদের মতো ওরাও বলে উঠেছে বাহ ! তাজ ।
কথায় আছে সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েই জীবন । আমার ক্ষেত্রে আলাদা তো কিছু হবে না ! গত বছর যা চেয়েছিলাম তার অনেকাংশ পূরণ হয়েছে । আগামী বছরের জন্য বাকিটা তোলা থাকল না হয় । আগামীর স্বপ্ন ? যদি এখনই সব লিখে দিই, তাহলে পরেরবার কী লিখব ???