এখনও পুকুর পাড়ে ‘গুমরে কাঁদে’ শহিদ সাঁওতাল যোদ্ধারা

১৮৫৫। তখন কোম্পানির শাসন। মানে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। সময়টা ছিল খুব অশান্ত। বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরভূম জেলার বড় অংশ জুড়ে তখন বিদ্রোহের ধামসা বাজছে। ভোগনাডিহ গ্রামের চার ভাই আগুন জেলে দিয়েছেন। শুরু হয়েছে 'সান্তাল হুল।'

Advertisement
এখনও পুকুর পাড়ে ‘গুমরে কাঁদে’ শহিদ সাঁওতাল যোদ্ধারাফাইল ছবি
হাইলাইটস
  • বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরভূম জেলার বড় অংশ জুড়ে তখন বিদ্রোহের ধামসা বাজছে
  • ভোগনাডিহ গ্রামের চার ভাই আগুন জেলে দিয়েছেন
  • শুরু হয়েছে 'সান্তাল হুল'

রাস্তার ধারে একটা মজা পুকুর। তাতে এই গ্রীষ্মে নাম মাত্র জল। বাকি পুকুর জুড়ে কচুবন, ঘাসবন। পুকুরে গরু চরছে। কয়েকটা বক পোকা খুঁটছে। কিন্তু একদিন এই পুকুরেই ডুবেছিল শতাধিক বিদ্রোহী আদিবাসীর ক্ষত বিক্ষত দেহ। ডুবিয়ে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুলিশ।

১৮৫৫। তখন কোম্পানির শাসন। মানে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। সময়টা ছিল খুব অশান্ত। বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরভূম জেলার বড় অংশ জুড়ে তখন বিদ্রোহের ধামসা বাজছে। ভোগনাডিহ গ্রামের চার ভাই আগুন জেলে দিয়েছেন। শুরু হয়েছে 'সান্তাল হুল।' সিদো, কানহো, চাঁদ, ভৈরব মুর্মুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছে সাঁওতালরা। সুদখোর মহাজনের শোষণ, জমিদারের অত্যাচার, রেল লাইন পাতার কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা আদিবাসী মেয়েদের প্রতি ব্রিটিশ অফিসার ও তাদের আড়কাঠিদের কুনজর, জমি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন দমনে নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুলিশ। ইতিমধ্যে ৩০ জুন সাহেবগঞ্জের কাছে পাঁচকাটিয়ার গাছতলায় রুজ পদবিধারী বাংলাভাষী সুদখোর মহাজনকে বলি দিয়েছে সিদো মুর্মু, কানো মুর্মুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা। দুমকা, সাহেবগঞ্জ, পাকুড়, সিউড়িতে মহাজন, জমিদারের লেঠেল বাহিনী ও কোম্পানির পুলিশের সঙ্গে লড়ছে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা। তাতে যোগ দিয়েছে মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতি বাহিনী। মত্ত হাতির পায়ের তলায় ধ্বংস হচ্ছে সাঁওতালদের ঘরদোর। জারি হয়েছে সামরিক আইন। এখানে সেখানে মারা পড়া বিদ্রোহীদের গণ কবর দিচ্ছে পুলিশ। এমন সময় সিউড়ি থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে রানিশ্বরে ঘটে গেল একটি ঘটনা। রানিশ্বর তখন রাজনগর থানার একটি গ্রাম। এই রানিশ্বরে ময়ূরাক্ষী নদীর আমজোড়া ঘাটে জড় হল বিদ্রোহী সাঁওতালদের বড় একটি দল। বর্ষার ময়ূরাক্ষী হেঁটে, সাঁতরে পার হয়ে, সিউড়ি হয়ে তারা কলকাতায় যেতে চায় বিদ্রোহের আঁচ পৌঁছে দিতে। লাটসাহেবের মুখোমুখি হতে। কিন্তু এই আমজোড়া ঘাটেই তাদের রুখে দিল পুলিশ। মাঝ নদীতে তির-ধনুকধারী সাঁওতালদের সঙ্গে লড়াই হল বন্দুকধারী কোম্পানির পুলিশের। তাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল শতাধিক বিদ্রোহীর শরীর। এ বার এতগুলো দেহ নিয়ে কী করা যায়! পুলিশ ঠিক করল নদীর ধারেই দিগুলি গ্রামের বড় পুকুরটায় ফেলা হবে দেহগুলো। তখন পুকুরের আশে পাশে ঘর নেই। ঝোপঝাড়, গাছপালায় ভর্তি। সেই পুকুরে ফেলা হল শহিদ সাঁওতাল বিদ্রোহীদের দেহগুলি। সেই সব দেহ পচে উঠলো। দিগুলির আকাশে শকুন উড়তে লাগলো। পুকুর পাড়ে শকুনে শেয়ালে ছিঁড়ে খেতে লাগলো শোষণ মুক্তির স্বপ্ন দেখা আদিবাসী যোদ্ধাদের দেহগুলো। গাঁয়ের মানুষ আতঙ্কে ওই পুকুরমুখো হওয়াই ছেড়ে দিল। ওই একই সময়ে সিউড়ি স্টেশনের কাছে কেন্দুয়া ডাঙালে গণ কবর দেওয়া হল বহু শহিদ সাঁওতালকে। ওদিকে সিদো- কানহোরাও ধরা পড়ল। সিদোকে সেই পাঁচকাটিয়ায় গাছের ডালে ফাঁসি দেওয়া হল যেখান থেকে বিদ্রোহের সূত্রপাত। কানহোর ফাঁসি হল ভোগনাডিহ গ্রামে। বিদ্রোহে শহিদ হলেন ১৫,০০০ আদিবাসী। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলেও ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যায় শোষণ মুক্তির এই মহাসংগ্রামের কথা। এই ধাক্কা সামলে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা বীরভূম জেলা ভেঙে গঠন করল সাঁওতাল পরগনা জেলা। কিন্তু রইল বাংলা প্রেসিডেন্সিতেই। পরে ১৯১১ সালে বিহার-ওড়িশা প্রেসিডেন্সি তৈরি করে সাঁওতাল পরগনাকে জোড়া হল তার সঙ্গে। ১৯৩৬ সালে বিহার এবং ওড়িশা আলাদা হয়ে যাওয়ায় সাঁওতাল পরগনা থেকে গেল বিহারে। ২০০০ সাল থেকে যা ঝাড়খণ্ডে।

Advertisement

এই সেই পুকুর
এই সেই পুকুর

ফিরে আসি সেই সাঁওতাল কাটা পুকুরের কথায়। হ্যাঁ, ওই নামেই পরিচিত দুমকা জেলার দিগুলি গ্রামের ওই পুকুর। এই পুকুরটিকে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারকগুলির তালিকাভুক্ত করার জন্য দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে এসেছে 'সাঁওতাল কাটা পুকুর স্মারক সমিতি'। নেতৃত্বে সমিতির সচিব গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের চেষ্টায় গড়ে তোলা জনমতের চাপে পড়ে, ইতিহাস খতিয়ে দেখে শেষ পর্যন্ত 'সাঁওতাল কাটা পুকুর'কে 'সান্তাল হুল' বা সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকার। সেখানে সরকারি উদ্যোগে বসানো হয়েছে পুকুরের ইতিহাস সম্বলিত বোর্ড। দুমকা জেলা প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে এই আর্থিক বছরেই শুরু হবে পুকুরটি সংস্কারের কাজ। তবে রানিশ্বরের মানুষ চান ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে আমজোড়াতেও তৈরি হোক শহিদ স্মারক। যেমন অসমের গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্রের ধারে সরাইঘাট যুদ্ধের স্মারক রয়েছে। রানিশ্বর তথা দুমকার মানুষ চায় ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পাক সাঁওতাল কাটা পুকুর। তাঁরা চান, সব কিছু হোক পুকুর ও নদীর ঘাটের স্বাভাবিকতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রেখে। তবে অঞ্চলিক ইতিহাসের অনুসান্ধানী গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা চান, আমজোড়া ঘাটে যারা শহিদ হয়েছিল তাদের নাম প্রকাশ করা হোক। তাঁদের ধারণা, সেই তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যাবে এমন অনেকের নাম আছে যারা সাঁওতাল নয়। এবং এই তথ্য প্রমাণ করবে সাঁওতাল বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল সহমর্মী প্রচুর অ-আদিবাসী মানুষ। কারণ তারাও একই ধরনের শোষণের শিকার ছিল। কিন্তু শহিদের সেই তালিকা ঝাড়খণ্ড বা বিহার সরকারের কাছে নেই। কারণ সাঁওতাল পরগনা বাংলা থেকে ওড়িশা-বিহার প্রেসিডেন্সি, পরে বিহার হয়ে ঝাড়খণ্ডে এলেও 'সান্তাল হুল' বা সাঁওতাল বিদ্রোহের নথিপত্র পশ্চিমবঙ্গের কাছেই রয়ে গেছে। কারণ ব্রিটিশরা সেই নথিপত্র অন্য কোনও প্রেসিডেন্সিকে বা রাজ্যকে হস্তান্তর করেনি। সাঁওতাল কাটা পুকুর স্মারক সমিতি চায় সেই নথি এবার নিজেদের কাছে নিয়ে আসুক ঝাড়খণ্ড সরকার।

সাঁওতাল কাটা পুকুরও সেই অপেক্ষায় আছে। খর রোদ্দুরে পুকুর পাড়ে গরু চরাতে চরাতে গামছায় মুখ মুছে বললেন এক বৃদ্ধ রাখাল। তাঁর ধারণা, এখনও নির্জন দুপুরে বা নিশুত রাতে এই পুকুরে গুমরে ওঠে শহিদ যোদ্ধাদের কান্না। সে কী, বীর শহিদরা কাঁদতে যাবে কেন? এবার বৃদ্ধ চোখ দুটো তুলে বললেন, ''কাঁদবে না তো কী করবে? যে শোষণ আর অনাচার থেকে মানুষ, মাটি, জল, জঙ্গলকে মুক্ত করতে প্রাণ দিয়েছিল হুল ক্রান্তির বীরেরা, তা আর হল কই! 'আবোয়া দিশোম আবোয়া রাজ' স্লোগান দিয়ে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন হল, আলাদা রাজ্য তৈরি হল। কিন্তু শোষণ, অত্যাচার, প্রকৃতি ধ্বংস কোনটা বন্ধ হয়েছে? খালি অত্যাচারীর মুখগুলো বদলে গেছে। সেই তো জমি বেদখল হচ্ছে। পাহাড় কেটে পাথর খাদান হচ্ছে।'' একজন বৃদ্ধ রাখালের মুখে এমন গোছানো সত্য শুনে অবাক হওয়ার মুহূর্তে প্রায় শুকনো পুকুরের বুক থেকে উড়াল দিল এক ঝাঁক বক।

Advertisement

(এই লেখনীর বক্তব্য লেখকের নিজস্ব। আজতক বাংলা কোনওভাবেই এর দায় নেবে না) 

POST A COMMENT
Advertisement