
কত দূর, আর কত দূর...। হেঁটে চলেছেন সারি সারি মানুষ। মা-বাবার হাত ধরে হাঁটতে থাকা শিশুটির মুখে বিস্ময়। বাবাকে সে জিগ্গেস করছে, বাবা আর কত দূর? ছেলে ভোলানো গল্প শোনাচ্ছেন এক ভদ্রলোক। অনেকটা পথ। নিয়ন আলো মাখা বালি ব্রিজের রাস্তায় অনেক পথচারীর ছায়া আজ।
আমিও হাঁটছি। হঠাত্ পাশ থেকে এক মাঝবয়সী মহিলা জিগ্গেস করলেন, 'বাস পাননি?' আমি বললাম, 'পেলেও যাই না, আমার হেঁটেই এই ব্রিজটা পেরতে ভাল লাগে।' এরপর যা শুনলাম, তা রীতিমতো ভয়ের। মহিলা বললেন, 'আমি ধুলাগড় কীভাবে যাব? কত দূর হাঁটতে হবে?' থতমত খেয়ে গেলাম। আমি হাঁটছি শখে, উনি হাঁটছেন নিরুপায় হয়ে। আপনি জানতেন না ব্রিজ বন্ধ থাকবে? জিগ্গেস করলাম। উনি বললেন, 'না, জানতাম না। কতক্ষণ লাগবে এখান থেকে ধুলাগড়?'
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। 'আপনি কি হেঁটে যাবেন ঠিক করেছেন?' মহিলা বললেন, 'অন্য উপায় তো দেখছি না। কারও বাইকে যদি যাওয়া যেত। কেউ যদি একটু এগিয়ে দিত।' এই কথা শেষ করেই উনি মোটরবাইককে হাত দেখিয়ে দাঁড়ানোর অনুরোধ করতে শুরু করলেন। কেউ দাঁড়াল না। কেউ কেউ বললেন, ধুলাগড় যাচ্ছে না। অতঃপর, মহিলা ফের হাঁটছেন। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, 'এমন জানলে আজ বাড়ি থেকেই বেরতাম না। কী যে হবে!'
তারপরেই জিগ্গেস করলেন, আচ্ছা দাদা, ক্যাব পাব? সত্যি বলতে কী, ক্যাবও অমিল। হঠাত্ বললেন, 'ট্রেনে যাওয়া যাবে তো?' আমি বললাম, না, ট্রেন তো সম্পূর্ণ বন্ধ এই লাইনে। বলার পরেই বুঝলাম, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে উনি আনমনা। তারপর বললেন, 'বালিতে আমার এক আত্মীয় থাকে, কিন্তু তার বাড়িতে কখনও যাইনি। আজ মনে হচ্ছে, ওখানেই রাত কাটাতে হবে।' আমি বললাম, 'সেই ভাল। আপনি ওই আত্মীয়ের বাড়িতেই আজ থেকে যান।' মনে হল, উনি বিকল্প খুঁজছেন আরও।
উদ্বেগের সঙ্গে যখন ব্রিজের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছি, হঠাত্ মহিলা বললেন, 'আমাকে দেখিয়ে দিন না ভাই, কীভাবে ধুলাগড় যাব, আমি এদিকের রাস্তা চিনি না।' আমার কাছে সত্যিই কোনও উত্তর নেই। বালিঘাটের রাস্তা চলে গিয়েছে ডানকুনির দিকে। অন্ধকার। কিছু পুলিশ পাহারায় রয়েছে, বড় গাড়ি ব্রিজে যাতে না উঠে যায়। আমি বললাম, রাস্তা ওইটা। কিন্তু হেঁটে যাওয়ার কথা কল্পনাও করবেন না। উনি কী বুঝলেন কে জানে!
মহিলা অন্ধকার রাস্তার দিকেই হাঁটতে শুরু করলেন। কোথায় গেলেন? বাড়ি কি আদৌ পৌঁছলেন তিনি? সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে গেল ওই অন্ধকারেই। তখন রাত ৯টা ১৫।