একুশের বিধানসভা ভোটে একাই বিজেপির তাবড় তাবড় কেন্দ্রীয় নেতাদের দুরমুশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়েছেন তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তারপর থেকেই রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করছে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী-বিরোধী ‘মুখ’ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি উঠে আসবেন?
নেটমাধ্যমে ইতিমধ্যে ২০২৪-কে টার্গেট করে ‘বাঙালি প্রধানমন্ত্রী’ হ্যাশট্যাগে প্রচার শুরুও হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিজেপি-বিরোধী নেটাগরিকদের বড় অংশ এই প্রচারে সামিল হয়েছেন।
মোদী-শাহদের হারাতে পারবেন মমতাই, এমন বার্তাও ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিরোধী নেতাদের মুখেও শোনা যাচ্ছে। একুশের ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ে উচ্ছ্বসিত বিজেপি বিরোধী দলগুলি। এই মুহূর্তে বিজেপি-বিরোধী প্রধান মুখ হিসেবে গোটা দেশের নজর কেড়েছেন মমতা।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে কেন্দ্রে মোদী বিরোধী মুখ হিসেবে বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চাইছে একাধিক বিরোধী শিবির। বাংলায় তৃণমূলের দাপট দেখে মমতা প্রশংসায় মুখর হয়েছে অনেক সরকার বিরোধী দলই। আবার সমস্ত সরকার বিরোধীদলগুলোকে একজোট হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। উনিশের ভোটেও বিজেপি বিরোধী জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন মমতা। ২৪-এর ভোটে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আর তাতে সাফল্য আসলে স্বাধীনতার ৭৭ বছরে প্রথম কোনও বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসবেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে বাঙালি রাষ্ট্রপতির স্বাদ পূরণ হয়েছে কিন্তু বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা শেষ হয়নি। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই সেই স্বপ্ন দেখছেন আপামর বাঙালি। তবে সবকিছু ঠিকঠাক চললে সেই অপেক্ষার অনেক আগেই অবসান হতে পারতো। জ্য়োতি বসুই হতেন দেশের প্রখম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী। একবার নয় তিন-তিনবার সেই সুযোগ নাকি পেয়েছিলেন তিনি। তারমধ্যে দু'বার নাকি অনুরোধ করেছিলেন স্বয়ং রাজীব গান্ধী।
আমরা সকলেই জানি, ১৯৯৬ সালে দেশের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু নিজের দলই তাতে আপত্তি তুলেছিল। তাই আর প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসা হয়নি জ্যোতিবাবুর। একেই পরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন 'ঐতিহাসিক ভুল' বা 'হিস্টোরিক ব্লান্ডার'|
কিন্তু কেবল ১৯৯৬ সাল নয় জ্যোতিবাবুর সামনে এমন সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল আরও আগেই। ১৯৯০ এবং ১৯৯১ সালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানান স্বয়ং রাজীব গান্ধী!
সিবিআইয়ের প্রাক্তন নির্দেশক বঙ্গসন্তান অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা বই 'আননোন ফ্যাসেটস অফ রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত' -তে রয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ১৯৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে বিশেষ সচিব পদে থাকার সময় রাজীব গান্ধী একদিন ডেকে পাঠান। বলেন, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। কথাও হয়। কিন্তু, গোটা ব্যাপারটি জ্যোতিবাবু ছেড়ে দেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর। কেন্দ্রীয় কমিটি ভেটো দিয়ে দেয়। ফাঁকতালে চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হন। আবার সুযোগ আসে ১৯৯১ সালে। চন্দ্রশেখরের পতনের পর ফের তৎপর হন রাজীব। তৎকালীন বাম সাংসদ বিপ্লব দাশগুপ্তের বাড়িতে একটি বৈঠকও হয়। রাজীব গান্ধী ব্যক্তিগত দূত পাঠিয়েছিলেন। যথারীতি জ্যোতি বসু দলের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেন, দল ভেটো দিয়ে দেয়।
২৩ বছর ১৬৫ দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। জীবদ্দশায় তাঁর রেকর্ড ভাঙতে পারেনি দেশের কোন মুখ্যমন্ত্রী। জনপ্রিয়তায় তাঁকে পাল্লা দেওয়া ছিল মুশকিল। ১৯৯৬ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন সিপিআইএম নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানায়, তখন তাঁর দলই বিরোধিতা করে। মূল বিরোধিতা করেছিলেন সিপিএম-এর শীর্ষ নেতা প্রকাশ কারাট। তাঁর সেই সিদ্ধান্তকে এখন ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে করা হয়। এখনও অনেক সিপিএম নেতা যা নিয়ে আক্ষেপ করেন।
নিজের বইয়ে অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, জ্যোতি বসুর তিনটি সুযোগেরই তিনি নিজে সাক্ষী ছিলেন। জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হত। এবারের একুশের ভোটে বাংলায় একটিও আসন পায়নি সিপিএম। ক্ষমতা হারাতে হয়েছে ত্রিপুরা থেকে। একমাত্র কেরলে টিমটিম করে জ্বলছে বামেরা। ক্রমেই দেশের রাজনীতিতে যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছেন বামেরা। জ্যোতি বসুকে নিয়ে অদূরদৃষ্টিতার ফল হয়তো ভোগ করতে হচ্ছে।
অনকেশ মনে করেন ‘বাঙালি’ বলে জ্যোতি বসু ও প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী না হতে পারায় প্রকাশ্যে কখনও আক্ষেপ করেননি। তবে নিজের আত্মজীবনী সিরিজের তৃতীয় খণ্ড দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস (১৯৯৬-২০১২)-এ মৃদু মনোবেদনার কথা জানিয়েছিলেন।
আর জ্যোতি বসুর কাছে সুযোগ এসেছিল বারবার তিনবার। ১৯৯০, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬। কিন্তু দল তাকে হতে দেয়নি। সেই বঙ্গ সন্তান আজ বেঁচে থাকলে বয়স হত ১০৭ বছর। চিরদিনই জ্যোতি বসু এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ একেবারে পৃথক। তবে বেঁচে থাকাকালীন জ্যোতি বসুকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ জ্যোতি বসুর চেয়ারে রয়েছেন মমতা। এখনও তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানান মমতা। দলের জন্য জ্যোতি বসু পারেননি মমতা বাঙালির স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন কিনা তা আপাতত সময়ের হাতেই ছাড়তে হবে।