বালিকা বধূ যখন শুটিং হচ্ছে তিনি তখন নাবালিকা। বা বাংলায় বহুল প্রচলিত শব্দ তিনি তখন বালিকাই ছিলেন। তরুণ মজুমদার তাঁকে আবিষ্কার করেন। কিন্তু মৌসুমির প্রতিভা তখন গোটা বাংলা দেখছে। এর মাঝেই হেমন্ত-পুত্র জয়ন্ত-র সঙ্গে বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। তখন ডাক আসছে মুম্বই থেকেও। তার মধ্যে বাংলায় আরও কয়েকি সিনেমায় অভিনয় করে ফেলেছেন। ১৯৪৮ সালে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন মৌসুমি।
স্মৃতি কথায় মৌসুমি বলেন, 'পরিবারের বাইরে প্রথম পুরুষ বলতে বাবু-র (জয়ন্ত) সঙ্গেই আমার পরিচয়। তিনিই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষ। তখন খুবই ছোট আমি। আমার খুব কাছের এক আত্মীয়া তখন মৃত্যু শয্যায়। তিনি জানিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে আমায় বধূ বেশে দেখতে চান। সিনেমায় বধূবেশে দেখলেও বাস্তব জীবনেও বিয়ে হয় খুব ছোট বয়সেই।' ১৯৭২ সালে বিনোদ মেহরার সঙ্গে অনুরাগ ছবিতে বলিউডে পা রাখেন মৌসুমি। ছবির পরিচালক ছিলেন শক্তি সামন্ত। সে বছর ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে অনুরাগ সেরা ছবির পুরস্কার পায়। ছবিতে এক অন্ধ মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মৌসুমি। বাংলা থেকে দূরে এলেও বাঙালিদের থেকে তিনি দূরে থাকেননি কখনও। তাঁর বহু সিনেমায় পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সহ অভিনেতারা বাঙালি ছিলেন।
তাঁর হিন্দির মধ্যে স্পষ্ট বাংলা টান ছিল চিরকাল। ১৯৭০-এর দশকে তিনি বলিউডের অন্যতম হাইয়েস্ট পেইড অভিনেত্রী ছিলেন। অমিতাভ বচ্চন থেকে রাজেশ খান্না, ঋষি কাপুর, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, বিনোদ মেহরা সকলের সঙ্গে হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন। হিন্দির পাশাপাশি বাংলা সিনেমাতেও তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। ১৯৮১ সালে উত্তম কুমারের শেষ ছবি ওগো বধূ সুন্দরী-তে তাঁর অনবদ্য অভিনয় আজও দর্শকদের মনে রয়েছে। এর মধ্যেই পরিবার বড় হয়েছে। দুই মেয়ে পায়েল এবং মেঘার জন্ম হয়েছে।
যে তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় তিনি নিজে সিনেমায় পা রেখেছিলেন, তাঁর ছবিতেই অভিনয় করে ছোট মেয়ে মেঘা পা রাখেন সিনেমায়। ২০০৬ সালে নির্মিত ভালোবাসার অনেক নাম ছবিতে মেঘার দিদির ভূমিকায় অভিনয় করেন মৌসুমি। এই ছবিতে ডেবিউ করেন উত্তম কুমারের নাতি গৌরব-ও। ছবি করা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিলেন মৌসুমি। তবুও ভালো চরিত্র সব সময় তাঁকে আকর্ষণ করেছে। তাঁর সাক্ষী জাপানিজ ওয়াইফ এবং গয়নার বাক্স। দুই ছবিতেই অনবদ্য অভিনয় করেছেন মৌসুমি। গয়নার বাক্সর জন্য সেরা সহ-অভিনেত্রীর ফিল্মফোর পুরস্কার পান তিনি।
ফিল্মোগ্রাফির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর জীবনেও বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ২০১০ সালে বড় মেয়ে পায়েল বিয়ে করেছেন মুম্বইয়ের বিজনেসম্যান ডিকি সিনহা-কে। ছোট থেকেই টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসে আক্রান্ত ছিলেন পায়েল। জীবনের সঙ্গে ওষুধ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। এর মধ্যে সুজিত সরকার পরিচালিত পিকু ছবিতে অভিনয় করার অফার পান মৌসুমি। আগেই বলেছি, ভালো চরিত্র পেলে তার প্রতি সুবিচার কী ভাবে করতে হয়, সেটা ভালোই জানতেন মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতেই শেষবার মৌসুমিকে দেখা গিয়েছে বড় পর্দায়। এর মাঝে রাজনীতির আঙিনাতেও পা রাখেন তিনি। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে নির্বাচনেও লড়েন তিনি। পরে ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন।
এর মধ্যে পায়েলের সাংসারিক অশান্তির খবরও সামনে আসে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হন পায়েল। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বাড়িতেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হত। মৌসুমি এবং স্বামী জয়ন্তর অভিযোগ ছিল, ডিকি মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। এমনকী মেয়ের সঙ্গে দেখাও করতে দিচ্ছিলেন না ডিকি। পায়েল কোমাতে চলে যান ২০১৮-য়। পায়েলের কাস্টডি চেয়ে আদালতে মামলাও করেন তাঁরা। তবে মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে জীবন থেকেই বিদায় নেন পায়েল। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন পায়েল।
মেয়ের চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি মৌসুমি। প্রায় সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বহিরাগত তকমা ঘোঁচাতে মরিয়া বিজেপি হন্যে হয়ে বাঙালি মুখের সন্ধান করেছে। মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপিতে যোগ দিয়ে সেই মুখের অভাব খানিকটা পূরণ করেন। মৌসুমি সেই মুখ হয়ে উঠতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু ব্যক্তিগত এত বড় শূন্যতা থেকে বেরতে পারলেন না তিনি। লাইম লাইট থেকে কয়েক যোজন দূরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তিনি।