বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র (Premendra Mitra)। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, ঔপ্যনাসিক, চিত্র পরিচালক, গীতিকার, সম্পাদক এবং বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের পুরোধা। ঘনাদা, মামাবাবু, মেজোকর্তার মত চরিত্রের স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্রের পেশাগত বৈচিত্র্যের মত তাঁর লেখনীও অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ।
নিজের অলস গুণপনাকে অসাধারণ ভাষায় বর্ণনা করে তিনি লিখে গিয়েছেন, ‘আত্মপ্রচারের অহমিকা থেকে নয়, অত্যন্ত অপরাধীর মতো সঙ্কোচভরে আমি স্বীকার করছি যে আমি অত্যন্ত কুঁড়ে... কেজো লোকেরা আমার নামে মুখ বিকৃত করে, বন্ধু-বান্ধবেরা হতাশার নিশ্বাস ফেলে, অনুরাগী যে দু’চারজন আছে তারা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ে... সম্পাদকেরা আমার কাছে সময়মতো লেখা পায় না, বন্ধু-বান্ধবেরা পায় না চিঠির জবাব। সদিচ্ছার আমার অভাব নেই— চিঠি পেলেই তার জবাব দেবার জন্য উৎসুক হই, কিন্তু লেখাটা বেশির ভাগ সময়ে মনে মনেই হয়, কলমের মুখে কাগজ পর্যন্ত পৌঁছোয় না।’
১৯০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বারাণসীতে প্রেমেন্দ্র মিত্রের জন্ম হয়। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল দক্ষিন চব্বিশ পরগনায়। মা সুহাসিনী দেবী। বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন একজন রেলকর্মী। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। খুব ছোটবেলায় মাকে হারান তিনি। বড় হয়ে ওঠেন ঠাকুরমা ও ঠাকুরদাদার সান্নিধ্যে উত্তরপ্রদেশে। কিন্তু তাঁর পরবর্তী জীবন শুরু হয় কলকাতা এবং ঢাকা শহরে। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু অল্প দিনেই বুঝে যান ছাত্রপেটানো তাঁর দ্বারা হবে না। একটি ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করার সময় তিনি বুঝতে পারেন, সৃজনধর্মী লেখার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু সেটা ঠিক কতটা তার হয়তো তখন পর্যন্ত আভাস পাননি। কিছু দিন চাকরি করার ছেড়ে দিয়ে সাহিত্য সাধনায় নিমজ্জিত করেন নিজেকে।
১৯২৩ সালে তিনি ঢাকা শহর থেকে ফিরে কলকাতার গোবিন্দ লেনের একটা মেসে থাকতে শুরু করেন। সেখানে তিনি দুটো গল্প লিখে সেই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৪ সালে প্রবাসীতে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘শুধু কেরানী’। পরের সংখ্যাতে তাঁর পরবর্তী গল্প ‘গোপনচারিনী’ প্রকাশিত হয়। এই দুটি গল্প নিয়ে কল্লোলে সেই সময়ে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয় যা তাঁকে সাহিত্য অঙ্গনে একটা অনন্য আসন দেয়। গল্পের পাশাপাশি তাঁর কবিতাও ছিল সমান তীক্ষ্ণ ও তীব্র যা বাংলা সাহিত্যে একটা জোরাল স্বাক্ষর রাখে। তিনি প্রথম জীবনে ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’ ছদ্মনামে লিখতেন। অল্পদিনেই তিনি কল্লোল পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মুরলীধর বসুর অনুরোধে কালিকলম পত্রিকার সম্পাদনায় হাত লাগান। তিনি পরবর্তীকালে একে একে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সায়েন্স ফিকশন, রম্যরচনা, শিশু সাহিত্য, চিত্রনাট্য, ফিল্ম নির্দেশনা ও গানের কথা লেখায় নিজের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি আন্তর্জাতিক মানের মতবাদকে সমীহ করলেও তা নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। বরং তা গ্রহণ করেছেন স্বদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে। মৃদু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পরিবেশন এবং কপটতার বিরুদ্ধে কষাঘাত তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য।
তাঁর লেখায় অনিবার্যভাবে ফুটে ওঠে নগরজীবনের ধোঁয়াশা, অনিবার্য ব্যর্থতা, অভিমানের পরাভব, জীবনের বিশেষ অনিবার্যতা। কর্মজীবনের বৈচিত্র্যের মত তাঁর লেখাতেও প্রতিফলিত হয়েছে বৈচিত্র্যের নানা রং। প্রেমেন্দ্র মিত্রের উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলি হল – প্রথমা, সম্রাট, ফেরারী ফৌজ, সাগর থেকে ফেরা, অনন্যা। ছোট গল্পের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পঞ্চশর, ধূলি ধূসর, পুতুল ও প্রতিমা। শিশু সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী, মিষ্টি মেঘ; রম্যরচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ক্লু, বিশ্বম্ভরবাবুর বিবর্তনবাদ; কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- যুদ্ধ কেন থামল, আকাশের আতঙ্ক, শুক্রে যারা গিয়েছিল। উপন্যাসের মধ্যে পাঁক, ওরা থাকে ওধারে, হাত বাড়ালেই বন্ধু। তাঁর সৃষ্ট কিছু অমর চরিত্র হল – ঘনাদা, মামাবাবু, পরাশর বর্মা, মেজোকর্তা। প্রেমেন্দ্র মিত্র বেশ কিছু চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সমাধান, বিদেশিনী, পথ বেঁধে দিল, হিন্দিতে রাজলক্ষী, নতুন খবর, কালোছায়া, কুয়াশা, সেতু, হানাবাড়ি, ডাকিনির চর, চুপি চুপি আসে।
তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তার কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল – শরৎ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫৪)। ১৯৫৭ সালে তিনি বেলজিয়ামে যান। সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বিশ্ব কবিতা উৎসবে যোগদানের জন্য ভারতীয় দলের নেতা হিসেবে। ১৯৫৭ সালে “সাগর থেকে ফেরা” র জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৫৮ সালে পান রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৫৮ সালে ঘনাদার সিরিজের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে শিশু সাহিত্য পুরস্কার পান। ১৯৬২ সালে তিনি ইউনাইটেড স্টেট থেকে লিডার গ্রান্ড পান এবং ইংল্যান্ড ও ইউনাইটেড স্টেড ভ্রমণ করেন। ১৯৭৩ সালে পান আনন্দ পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে পান নেহেরু পুরস্কার সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে। ১৯৮১ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান ডি. লিট। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান জগত্তারিনী সোনার পদক। ১৯৮৪ সালে পান বিদ্যাসাগর পুরস্কার।১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বিশ্বভারতী থেকে পান দেশিকোত্তম পুরস্কার। তিনি এত পুরস্কারের পাশাপাশি পদ্মশ্রী ও মৌচাক পুরস্কারে ভূষিত হন।
এত কিছু করার পরেও যিনি নিজেকে কুঁড়ে সম্বোধন করতে পারেন, তাঁর চেয়ে বড় আত্মসমালোচক আর কে হতে পারেন। তবে কুঁড়েমি ছিল বইকি। নিজের শরীরের খেয়াল রাখার পবিষয়ে কুঁড়েমি ছিল। ক্যানসারের যন্ত্রণা তাঁর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করলেও তিনি তা কাউকে বুঝতে দেননি। ১৯৮৮ সালে বিশ্বভারতীতে রাজীব গান্ধীর হাত থেকে দেশিকোত্তম পুরস্কার নিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা অটোগ্রাফের জন্য খাতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। হাসিমুখে এঁকে দিচ্ছেন সই। সে বছরই এই মে মাসেই চলে গেলেন তিনি। ক্যানসারের যন্ত্রণা নিয়েই।