২৯ বছর আগে আজকের দিনে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ 'সিনেমাওয়ালা' সত্যজিৎ রায়। সিনেমাওয়ালা শব্দটি পড়ে অনেকে রে রে করে উঠতে পারেন। কিন্তু এটা লেখার পিছনে ছোট্ট একটা যুক্তি রয়েছে। তাঁকে শুধু পরিচালক বললে মিথ্য বলা হবে। টিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক, গীতীকার, সংলাপ রচয়িতা, সাজসজ্জা, সিনেম্যাটোগ্রাফার, সম্পাদক... কত কী লিখতে হবে তার ঠিক নেই। সিনেমাওয়ালা বললে বোধহয় সবটাই ধরানো সহজ হয়। সিনেমাওয়ালা, যিনি সিনেমা নিয়ে আসেন। আর এমন সমস্ত সিনেমা এনেছেন, যার অনেকগুলির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। অন্তত এই অধম লেখকের তা মনে হয়।
লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট বিভাগে অস্কার জিতেছেন সত্যজিৎ। এ কথা সকলেই জানেন। মৃত্যু সজ্জায় সত্যজিতের হাতে সেই পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন অস্কার কমিটির প্রতিনিধিরা। জীবনের একেবারে শেষ দৃশ্যে এসে এই পুরস্কার দিয়ে যেন খানিকটা পাপ স্খলন করেছিল অস্কার কমিটি। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত, কেউ এর সঙ্গে একমত না-ও হতে পারেন, তবে আমার মনে হয় তিনি বেশ কয়েকটি ছবির জন্য অস্কার পেতে পারতেন। তুলসি চক্রবর্তী, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত প্রভৃতি মহান অভিনেতাদের সম্পর্কে যে কথা সত্যজিৎ একাধিকবার বলেছেন, সে কথা তাঁর জন্যেও সমান ভাবে প্রযোজ্য ছিল। তিনি যদি পাশ্চাত্যের কোনও কোনও দেশএ জন্মগ্রহণ করতেন, তবে একাধিক অস্কার শোভা পেত তাঁর শো কেসে। শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ পরিচালক বা সেরা ছবি বিভাগেই নয়, বহু বিভাগে অস্কার জিততে পারতেন সিনেমার 'মানিক'।
পথের পাঁচালী: জীবনের প্রথম ছবি। কিন্তু মন প্রাণ ঢেলে তৈরি করেছিলেন ছবিটি। টাকার অভাবে বার বার থমকে গিয়েছে শুটিং। কিন্তু সত্যজিৎ থামেননি। রবিশঙ্করের আবহ, সেতারের মূর্ছনা ছবিটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। ১৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এসেছিল। টাকার অভাব তো ছিলই, তার সঙ্গে প্রযুক্তিগত নানা সমস্যা ছিল। একটি দৃশ্যে হাঁড়ির নীচ কেটে তার মধ্যে ক্যামেরার লেন্স লাগিয়ে শুট করেছিলেন সত্যজিৎ। ছবির উপস্থাপনা সকলকে মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু বেশ কিছু দিন পরে। ছবিটি সর্বকালের শ্রেষ্ট চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু অস্কার মেলেনি। ছবির বাকি দুই সিক্যুয়েল, যাকে সকলে অপু ট্রিলজি হিসাবেই জানেন, তার জন্যেও অস্কারে মনোনীত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকত না।
পরশ পাথর: ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি শুধুমাত্র তুলসি চক্রবর্তীর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলির মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে। অনেকে বলবেন পরশুরামের গল্প নিয়ে তৈরি, তাই মৌলিকতা নষ্ট হয়েছে। বলতেই পারেন, তাতে কিছু যায় আসে না। বিশ্ব চলচ্চিত্রে এমন ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ আছে। পথের পাঁচালীও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, ভুলে গেলে চলবে না। এই ছবিতেও রবিশঙ্কর তাঁর সেতারে মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছিলেন।
গুপী গাইন বাঘা বাইন: একটা ছোট্ট ৪ পাতার গল্প থেকে যে এমন একটা সিনেমা তৈরি করা যায়, তা-ও ১৯৬৮ সালে, সেটা আজকের দিনে খুব কম মানুষ ভাবতে পারেন। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে, গান লেখা, সুর করা, সাজসজ্জা, পরিচালনা এবং শিশুদের জন্য মানিকজোড় গুপী এবং বাঘাকে খুঁজে দেওয়ার কৃতিত্ব পুরোটাই সত্যজিৎ রায়ের। জাতীয় পুরস্কার-সহ বেশ কয়েকটি দেশে সেরার শিরোপা পেয়েছিল ছবিটি। কিন্তু অস্কার মুখ ফিরিয়েই ছিল।
সোনার কেল্লা: ফেলুদা সিরিজের অন্যতম সেরা গল্প। নিজের লেখা হলেও সিনেমায় বেশ কিছু পরিবর্তন করেছিলেন। এখানেও তিনি যথারীতি ওয়ান ম্যান আর্মি। একার হাতেই প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করেছেন।
হীরক রাজার দেশে: গুপী বাঘা সিরিজের দ্বিতীয় ভাগ। একটি সিনেমার প্রায় গোটাটাই ছন্দ মিলিয়ে লেখা! শিশুদের জন্য তৈরি মনে হলেও, এটি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ছবি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই সিনেমায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সিনেমাটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। আলাা করে পাওয়া সিনেমার গান। ৪টি জাতীয় পুরস্কার জিতেছিল ছবিটি। পেয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও।
আগন্তুক: দ্য স্ট্রেঞ্জার। এমন একজনের গল্প, যিনি মনোমোহন মিত্র হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। সত্যজিৎ রায় আগেই বলে রেখেছিলেন গল্পের মূল প্রটাগনিস্টের চরিত্রে অভিনয় করা উৎপল দত্তকে। তিনি যদি অভিনয় না করেন, তবে ছবিটি তৈরি করবেন না। ভাগ্যিস করেছিলেন! নিজের ভাবনা, মনন এবং শিক্ষার একটা সংক্ষিপ্ত নির্যাস মনোমোহন মিত্রের মুখ থেকে বলিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। একাধিক জাতীয় পুরস্কার জিতেছিল ছবিটি।