প্রেম বড় বিষম বস্তু! বয়স, জাত, ধর্ম, দেশ, কাল সীমানা কিছুই মানে না। যেমনটা মানেননি পরিচালক কল্পনা লাজমি। ভূপেন হাজারিকা। যাঁকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন, সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন এবং প্রেম করতেন। অনেকে বলতে পারেন, প্রেম আর ভালোবাসা কি আলাদা? হ্যাঁ, অবশ্যই আলাদা। বহু মানুষকে ভালোবাসা যায়। তবে প্রেম বহু মানুষকে করা যায় না। প্রেম খানিকটা নিপাতনে সিদ্ধ। যাঁকে প্রেম করবেন, তাঁকে কোনও কারণ ছাড়াই প্রেম করতে হবে। দোষ গুণ সমেত। কল্পনা লাজমি-ও সেই ধাতে গড়া মানুষ ছিলেন। জীবনে একজনই ভালোবেসেছেন। তাঁর জন্য কেরিয়ার, কাজ সব ত্যাগ করে রাধার মতো লিভ ইন করেছেন। তিনি কল্পনা লাজমি।
ভারতীয় সিনেমায় খুব কম পরিচালক রয়েছে যিনি মাত্র ৬টি সিনেমা করে তৈরি করে মানুষের মনে চিরকাল স্থান পাকা করে নিয়েছেন। সম্ভবত কল্পনা লাজমি একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই অসাধ্যসাধন করতে পেরেছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথমবার ভূপেন হাজারিকাকে দেখেন কল্পনা লাজমি। প্রথম দর্শনেই অনুরক্ত হয়ে পড়েন নিজের চেয়ে ৩৫ বছরের বড় মধ্যবয়সি এক ব্যক্তির প্রতি। পরে ধীরে ধীরে সেই অনুরাগ প্রেমে পরিণত হয়। প্রথম দিকে সে প্রেম অবশ্য কল্পনার এক তরফাই ছিল। তত দিনে অবশ্য বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে ভূপেনের। নিজের আত্মজীবনী Bhupen Hazarika: As I Knew Him-এর ছত্রে ছত্রে সেই কাহিনি তুলে ধরেছেন কল্পনা।
নারী মনকে খুব ভালো বুঝেছেন লাজমি। সে কারণে তাঁর সমস্ত সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে নারীরাই জায়গা করে নিয়েছে। রুদালি থেকে চিঙ্গারি পর্যন্ত। প্রথম সিনেমা এক পল মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। তার আগে অবশ্য বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ এবং ফারুক শেখ অভিনীত ছবিটি তিনি একাধারে প্রয়োজনা করেছেন এবং পরিচালনাও। গুলজার সাহেবের সঙ্গে সিনেমাটি লিখেছেনও। এই ছবিতে সঙ্গীত দিয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা। ১৯৮৮ সালে দুরদর্শনের জন্য লোহিত কিনারে ধারাবাহিক পরিচালনার ভার সামলান। সিরিয়ালেও মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন শাবানার বোন তনভি আজমি।
বেশ কিছু দিন ব্রেক নিয়ে সিনেমায় ফিরে আসেন ১৯৯৩ সালে রুদালি ছবির মাধ্যমে। ছবিটি বক্স অফিসে সাফল্য পায়নি ঠিকই। কিন্তু সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল। যার জন্য ছবিটি আজও সকলে মনে রেখেছেন তা হল ছবির গান। ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীত পরিচালনায় লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে এবং খোদ ভূপেন অবিস্মরণীয় গান গেয়েছেন বেশ কিছু। এই ছবির জন্য প্রথম ভারতীয় হিসাবে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর পর একে একে দরমিয়াঁ, দমন, কিউঁ এবং চিঙ্গারি ছবি পরিচালনা করেন কল্পনা।
বয়সের ভারে ক্রমশ শরীরের অবনতি হতে থাকে ভূপেনের। সব কিছু ছেড়ে কল্পনা শেষ দিন পর্যন্ত ভূপেনের পাশে থেকেছেন। না, এর জন্য তিনি কোনও স্বীকৃতি পাননি। না সমাজের চোখে, না ভূপেনের আত্মীয়স্বজনের চোখে। কল্পনা অবশ্য এ সব নিয়ে কোনও দিন ভাবিত ছিলেন না। ধীরে ধীরে তাঁর শরীরেও মারণ রোগ ক্যানসার বাসা বাঁধে। ২০১১ সালে ভূপেন হাজারিকা প্রয়াত হওয়ার পর কল্পনা তাঁর সমস্ত কাজ, তাঁর লিগ্যাসি-কে রক্ষা করে গিয়েছেন। কল্পনার মৃত্যুর পর এই লিগ্যাসির কী হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তাও ছিল। মৃত্যু শয্যাতেও যে দুশ্চিন্তা তাঁর পিছু ছাড়েনি। সে জন্য চিকিৎসককে তিনি অনুরোধ করেছিলেন যাতে অ্যাম্বেলেন্সের ব্যবস্থা করে তাঁকে আত্মজীবনী প্রকাশ অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সে অনুমতি মেলেনি। তবে তাতে মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮-য় যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে চয়ে গিয়েছেন কল্পনা। কল্প লোকে।
সেখানে তিনি নিশ্চয়ই ভূপেনের দেখা পেয়েছেন। গান বাঁধছেন। হয়তো সিনেমাও তৈরি করছেন। সেখানে পুরস্কার নেই, তিরস্কারও নেই, শুধুমাত্র অফুরান প্রেমই তাঁদের মিলিয়ে রাখবে। রাধা-কৃষ্ণের মতো। স্ত্রীর আগে কৃষ্ণের সঙ্গে প্রেমিকা রাধার নামই নেওয়া হয়। ভারত হয়তো ভুলে গিয়েছে সে কথা।