
গত রবিবার নিজের জয় নিশ্চিত হতেই আগামী ৩০ অক্টোবর রাজ্যে হতে চলা চার উপনির্বাচনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শোভনবাবু যে খড়দা থেকে লড়বেন তা আগেই নিশ্চিত ছিল। স্বয়ং তৃণমূলনেত্রীই সেকথা জানিয়েছিলেন। এবার পুরো বিষয়টি অফিসিয়াল হয়ে যাওয়ার পর প্রচারের ময়দানে নেমে পড়েছেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী। একদা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কেন্দ্রে শোভনবাবুর জয়ের ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই বলাইবাহুল্য। তবুও ঢিলেমি দিতে চান না শোভনদেব। একদা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে ভোটের লড়াই শুরু করা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এই প্রথম উত্তর চব্বিশ পরগনার কোনও কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে লড়ছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শোভনবাবুই কিন্তু এরাজ্যে প্রথম বিধায়ক হিসাবে জোড়াফুল ফুটিয়েছিলেন।
তৃণমূলের প্রথম বিধায়ক শোভনদেব
রাজনীতির আঙ্গিনা বড়াবড়ই বড্ড নোংরা বলে মন্তব্য করে থাকেন অনেকে। তবে এই ময়দানেও যে কয়েকজন ভদ্র রাজনীতিক হিসাবে সম্মান আদায় করে নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গত মন্ত্রিসভায় তাঁকে ফার্স্ট বয় বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। সেই শোভনদেবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নতুন দল তৈরি করেন তখন কংগ্রেসের বিধায়ক পদ ছেড়ে উপনির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। এবরাও ফের একবার উপনির্বাচনের ময়দানে তিনি।
বারুইপুর থেকে খড়দার যাত্রা
১৯৬২ সালে রাজনীতিতে আগমন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী। সেবার বারুইপুর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন। ১৯৯৬ সালেও বারুইপুর থেকে জয়ীহন কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের সময় মমতার হাত ধরে দলবদল। ওই বছর মারা যান রাসবিহারীর কংগ্রেস বিধায়ক হৈমী বসু। বারুইপুর থেকে পদত্যাগ করে রাসবিহারীর উপনির্বাচনে প্রার্থী হন শোভনদেব। তারপর ১৯৯৮, ২০০১,২০০৬, ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ধারাবাহিক জয় রাসবিহারী থেকেই। ২০২১ সালে নেত্রীর নির্দেশে প্রার্থী হন ভবানীপুরে। সেখানেও রুদ্র ম্য়াজিককে ফেল ফেলিয়ে দিয়ে শোভনবাবু বিজেপির তারকা প্রার্থীকে হারান প্রায় ২৮ হাজারের কাছাকাছি ভোটে। তৃতীয়বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলে তাঁর মন্ত্রিসভায় জায়গা পান শোভনদেব। কিন্তু গত মে মাসেই ভবানীপুরের বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ভবানীপুর আসনটি তৃণমূলনেত্রীকেই ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। এদিকে মন্ত্রী থাকতে হলে শোভনবাবুকেও ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভায় জিতে আসতে হবে। তাই খড়দা থেকে তিনি যে ভোটে লড়বেন তা আগেই থেকেই স্থির ছিল।
শোভনের ওপরই ভরসা মমতার
একুশের ভোটে নন্দীগ্রাম থেকে লড়ে বড় চমক দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু তাঁর গড় বা ঘরের মাঠে কে লড়বেন তা নিয়ে আগ্রহ ছিল সবার। সবাইকে চমকে দিয়ে মমতা ভবানীপুরে আস্থা রেখেছিলেন রাসবিহারীর বিধায়কের ওপর। প্রসঙ্গত গত লোকসভা ভোটের নিরিখে ভবানীপুরে তৃণমূলকে কড়া টক্কর দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। তাই মমতার বিকল্প হিসাবে এমন কোনও মুখ এই কেন্দ্রে দরকার ছিল যিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেন। আর এই ক্ষেত্রে প্রবীণ রাজনীতিক শোভনদেবই যোগ্য বাজি ছিল মমতার।
খড়দার বর্তমান পরিস্থিতি
২০১১-র নির্বাচনে রাজ্যের প্রাক্তন বাম সরকারের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত খড়দা আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৬-র নির্বাচনে খড়দা থেকে জয়ী হয়ে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন অমিত মিত্র। তবে ২০২১ সালে ভোটের ময়দানে দেখা যায়নি অমিতবাবুকে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচনে লড়েননি তিনি। তাঁর জায়গায় দল প্রার্থী করে কাজল সিনহাকে। কাজলবাবু ভোটে জিতলেও ফল ঘোষণার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। ফলে এই আসনে উপনির্বাচন অবশ্যম্ভাবী ছিল। একুশের ভোটে কাজল সিনহা এই কেন্দ্র থেকে পান ৮৯,৮০৭ ভোট। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্ত পেয়েছিলেন ৬১,৬৬৭ ভোট। এবার তৃতীয়বার তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর খড়দা থেকে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত প্রথমবার তৃণমূলের বিধায়ক হয়েও দলের মধ্যে একটা সময় সেভাবে গুরুত্ব পাননি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। প্রথমবার দল ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রীও করা হয়নি তাঁকে। দ্বিতীয় মমতা সরকারে আসার পর অবশ্য শিকে ছেঁড়ে শোনবাবুর। হন বিদ্যুৎমন্ত্রী। সফল মন্ত্রী থেকেছেন তিনি। মমতার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় মন্ত্রিসভাতে অবশ্য বদলে গিয়েছে তার দফতর। বর্তমানে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী তিনি। অতীতে অন্যান্য রাজনীতিকদের মত কখনও বেঁফাস বলতে বা দলের প্রতি ক্ষোভ উগরাতে দেখা যায়নি তাঁকে। নির্দ্বিধায় দলনেত্রীকে ছেড়ে দিতে পারেন নিজের জেতা আসন। তাই তাঁকে নিয়ে ব্যক্তি আক্রমণে যেতে পারে না বিরোধী শিবিরও। একুশের ভোটে প্রতিপক্ষ রুদ্রনীল ঘোষ তৃণমূলকে নিশানা করলেও শোভনবাবুর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি।