এক যুগ আগে ২০০৭ সালে একটি স্বর্ণালী যুগের অবসান ঘটিয়ে চলে গিয়েছেন তিনি। উত্তম কুমার (Uttam Kumar) এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chatterjee) প্রবল দাপটের সময়ও অভিনেতা এবং সুদর্শন নায়ক হিসাবে নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (Shubhendu Chatterjee). তিনি কতটা সুদর্শন ছিলেন তার একটা স্পষ্ট ধারণা মিলবে একটি ঘটনার কথা শুনলে।
সালটা ১৯৬৯। কলকাতায় এসেছেন রাজ কাপুর (Raj Kapoor)। ৫ বছর পরিশ্রমের পর সদ্য শেষ করেছেন মেরা নাম জোকারের শুটিং। তাঁর সঙ্গে ছবির বেশ কয়েকজন শিল্পীও এসেছিলেন সে সময়। সেই উপলক্ষে পাঁচ তারা হোটেলে পার্টি দিয়েছিলেন বাংলা ছবির প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায়। সেই পার্টিতে রাশিয়ান ব্যালে শিল্পী কেসেনিয়া রায়াবিনকিনা-র (Kseniya Ryabinkina) সঙ্গে আলাপ হয় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের। যাঁরা মেরা নাম জোকার ছবিটি দেখেছেন তাঁদের আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই কে এই অসাধারণ সুন্দরী ব্যালে শিল্পী এবং অভিনেত্রী।
ছবিতে এক সঙ্গে কাজ করার সুবাদে কেসেনিয়া এবং সিমি গারেওয়াল (Simi Garewal) পরস্পরের ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। পরে এক দিন সিমির কাছে শুভেন্দুকে ভাল লাগার কথা জানিয়েছিলেন কেসেনিয়া। আর সেই কথা সিমি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শুটিং ফ্লোরে সকলের সামনে শুভেন্দুকে জানান। সে সময় ফ্লোরে উপস্থিত ছিলেন ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও (Satyajit Ray)। সিমির কথা শুনে শুভেন্দু তো লজ্জায় লাল! কথাটি জানিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকেননি সিমি। পার্স থেকে রায়াবিনকিনার একটি ছবিও শুভেন্দুকে বার করে দেন। ভালো লাগার চিহ্ন স্বরূপ যেটি সিমিকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ছবির পিছনে কেসেনিয়া লিখে দিয়েছিলেন, ‘টু শুভেন্দু , টু অল মাই হার্ট’।
ব্যাপার দেখে উপস্থিত সকলে হেসে উঠলেন। কিন্তু শুভেন্দুর তাতে অস্বস্তি এবং লজ্জা উভয়ই বেড়েছে। অসম্ভব রসিক সত্যজিৎ কালো কাপড়ে মোড়া ক্যামেরার লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা বলেছিলেন, ‘তা হলে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠাই, কী বলো শুভেন্দু?’ তাতে হাসির রোল বেড়েছিল শুটিংয়ের বিরতিতে। বাড়িতে ফিরে শুভেন্দু তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে যতটা ফেলনা ভাবো, আমি কিন্তু ততটা নই।’ পুরো ঘটনা শুনে ভীষণ হেসেছিলেন অঞ্জলী দেবী।
পেশায় চিকিৎসক দাদুর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে বাবার কথায় ডাক্তারি পড়েছিলেন অসম্ভব মেধাবী শুভেন্দু। ১৯৬০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করার পর প্রথমে সিভিল ডিফেন্স তার পর কলকাতা পুরসভায় হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলেন চিকিৎসক হিসাবে। কিন্তু তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল অভিনয়। কিছু দিন চাকরি করার পর ডাক্তারি ছেড়ে পেশাদার অভিনেতা হওয়ার অনিশ্চিত পথে হাঁটতে শুরু করেন। অভিনয়ের ইচ্ছে তাঁর মনে গেঁথে দিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ী। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর অভিনীত মাইকেল মধুসূদন নাটকটি দেখে অভিনয়ের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শুভেন্দু।
ডাক্তারি পড়তে পড়তেই আইপিটিএ-তে যোগ দেন তিনি। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে গুরু হিসাবে মেনে গিয়েছেন চিরকাল। সাল ১৯৬৫, আইপিটিএ-র মঞ্চে তাঁকে দেখে পরিচালক মৃণাল সেন তাঁর ছবি ‘আকাশকুসুম’-এ কাস্ট করেন শুভেন্দুকে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর বাংলার সেরা পরিচালকদের নজরে পড়ে যান শুভেন্দু। সে তালিকায় ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও। তাঁকে দেখে সিগারেট এগিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ঘটনা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘এই প্রথম কারও সামনে সিগারেট ধরানোর জন্য মাথা নিচু করতে হল না।’
ডেবিউ ছবির পরেই সুযোগ এল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে অভিনয় করার। তার পরের বছর ‘হংসমিথুন’ ও ‘চৌরঙ্গী’। পরিচালক অরূপ গুহর ‘পঞ্চশর’ ছবিটি জন্য ফ্র্যাঙ্কফুর্ট ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন শুভেন্দু। উৎসব শেষ হওয়ার পর আরও কিছু দিন থেকে শহরটি ভালো করে ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল শুভেন্দুর। কিন্তু ‘চৌরঙ্গী’র শুটিংয়ের জন্য ডেট দেওযা রয়েছে তাঁর। কী করবেন, ভাবতে ভাবতে তিনি ফোন করেন উত্তম কুমারকে। শেষ পর্যন্ত উত্তমের কথাতেই শুটিংয়ের ডেট পিছোনো হয়েছিল। একমাত্র শুভেন্দুর জন্যই নিজের ডেট পিছিয়েছিলেন উত্তম কুমার! উত্তম যেমন তাঁকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করতেন, তেমনই শুভেন্দু তাঁকে নিজের দাদার মতোই শ্রদ্ধা করতেন।
তার কারণও ছিল অবশ্য। ‘চিড়িয়াখানা’র শুটিংয়ে এক দিন ফ্লোরেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তম কুমার। চিকিৎসক শুভেন্দু বুঝতে পারেন উত্তমের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, কিন্তু তিনি সেটা উত্তম কুমারকে জানাননি। পাছে তিনি বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার সুনীল সেনকে ডাকা হয়েছিল উত্তমের চিকিৎসার জন্য। আউটডোর থেকে তৎক্ষণাৎ কলকাতার উদ্দেশে রওনা করা হয়েছিল উত্তমকে। সে যাত্রা তাই বড় কোনও ক্ষতি হয়নি। শোনা যায়, এই ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হলেই শুভেন্দুর মতামতের উপর ভীষণ ভরসা করতেন উত্তম কুমার।
এমন অনেক অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা সিনেমাপ্রেমীদের মনে চিরকাল সজীব থাকবে। একই ভাবে সজীব থাকবেন সুপুরষ সুদর্শন এই মানুষটি, যিনি নিজের অভিনয়ের স্বাক্ষর সোনা দিয়ে লিখেছেন, বাংলা ছবির স্বর্ণ যুগে।