তিনি স্ক্রিনে থাকলে অন্য কারও দিকে চোখ যাওয়া সম্ভব ছিল না। অমন এক্সপ্রেসিভ রাগী চোখ দিয়ে বড় বড় নায়কদের ল্যাজেগোবরে করে ছাড়তেন। তার সঙ্গে মানানসই জলদগম্ভীর কণ্ঠ। তিনি ভারতীয় সিনেমার অবিসংবাদী ভিলেন এবং চরিত্রাভিনেতা অমরীশ পুরী। অনস্ক্রিনে তাঁর 'ভীতিপ্রদ' উপস্থিতি থাকলেও তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত পরিবার অন্ত প্রাণ মানুষ। ১৯৩২ সালে আজকের দিনে পঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন অমরীশ পুরী।
অল্প বয়স থেকে দুই দাদা চমন পুরী এবং মদন পুরী-কে চুটিয়ে অভিনয় করতে দেখেছেন। কে এল সায়গল ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। তাই ছোট থেকে অভিনেতা হওয়ার শখ ছিল তাঁর। পড়াশোনা শেষ করে পঞ্চাশের দশকের দাদাদের দেখানো রাস্তায় পৌঁছে যান মুম্বইয়ে। এখন স্বজনপোষণ নিয়ে এত কথা হয়, তৎকালীন সময় দুই দাদার উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকতেও বলিউডে জায়গা করতে পারেননি তিনি। বার বার স্ক্রিন টেস্টে ফেল করে এক সময় অভিনয়ের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর্থিক ভাবেও নয়, অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার বিষয়েও নয়, দাদাদের কাছ থেকে তিনি কোনও সাহায্য পাননি। বম্বেতে টিকে থাকতে চাকরি খোঁজা শুরু করেন অমরীশ। পেয়েও যান একটি সরকারি চাকরি। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের অধীনে তিনি চাকরি পান এমপ্লয়িজ স্টেট ইনসিওরেন্স কর্পোরেশনে।
চাকরির পাশাপাশি অভিনয়ও করতে থাকলেন। সিনেমায় না হলেও মঞ্চে ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে শুরু করেন কয়েক বছরের মধ্যে। প্রায় ১৫ বছর মঞ্চাভিনেতা হিসাবে চুটিয়ে কাজ করেছেন অমরীশ। পৃথ্বী থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন তিনি। মঞ্চে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে তাঁকে সঙ্গীত নাটক অ্যাকেডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই মঞ্চই তখন বলিউডের রাস্তা খুলে দেয়। সত্তরের দশকেই তিনি বলিউডে পা রাখেন। প্রথণ দিকে ছোট ছোট চরিত্রে নজর কাড়ার পর প্রথম বড়া ব্রেক আসে ১৯৮০ সালে হম পাঁচ সিনেমায়। অমন জাঁদরেল ভিলেনের রূপ দেখে ভারতীয় দর্শকরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।
পরের আশি এবং নব্বইয়ের দশকে খলনায়ক এবং চরিত্রাভিনেতা হিসাবে অনবদ্য অভিনয়ের ছাপ রাখেন। অ্যাটেনবোরো-র গান্ধী এবং স্টিভেন স্পিলবার্গের ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য টেম্পল অফ ডুম ছবিতে অভিনয় করেন অমরীশ। স্পিলবার্গ বহু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, অমরীশ পুরী তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ভিলেন। এই সিনেমা থেকেই তাঁর বল্ড লুক বিখ্যাত হয়েছিল। তিনি শুধুমাত্র নিজের নামে নন, তাঁর জনপ্রিয় চরিত্রের নামেও বিখ্যাত। মোগ্যাম্বো থেকে বলবন্ত রাই, এমন বহু চরিত্রে আছে যার সংলাপ অনেকেই মুখস্থ বলতে পারবেন! ভিলেনের চরিত্রকেও যে এতটা জনপ্রিয় করা যায়, তাঁর মতো ভারতীয় সিনেমায় কেউ দেখাতে পারেননি। ৩৫ বছরের ফিল্ম কেরিয়ারে ৪০০-র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ভীষণ নরম মানুষ ছিলেন। জন্মদিনে হৈ-হুল্লোড় পছন্দ করতেন না। বাড়ির হোম থিয়েটারে হিচকক থেকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা চলত। পরিবারের সকলকে নিয়ে আনন্দ করতে ভালোবাসতেন তিনি। ত্যজিৎ রায় এবং কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন অমরীশ। ২০০৪ সালে মারণ রোগ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। এক বছরের মধ্যে ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ দিকে কোমায় আচ্ছন্ন থআকালীন ২০০৫ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।