অপু আর অপর্ণা। নাম দুটি উচ্চারণ করলে প্রথমেই চোখের সামনে যে মুখ দুটি ভেসে ওঠে তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) এবং শর্মিলা ঠাকুরের (Sharmila Tagore)। ছবিতে ত্রয়োদশী কন্যার খোঁজ করতে সত্যজিৎ রায়কে (Satyajit Ray) খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত ছাপাতে হয়েছিল। কিন্তু এই কন্যেকে দেখার পর সত্যজিৎ বুঝে যান, এর চেয়ে যথাযথ কাস্টিং আর হতে পারে না। জহুরির চোখ ঠাকুর পরিবারের এই মেয়েকে চিনতে ভুল করেনি। তাঁর ধরেই জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় সিনেমায় আর এক স্টার।
কখনও কাশ্মীর কি কলি, কখনও আরাধনা, কখনও ওয়ক্ত.... শেষ হবে না এমন এভারগ্রিন সমস্ত ছবি উপহার দিয়ে গিয়েছেন শর্মিলা। নায়ক ছবির সময়ও উত্তমের বিপরীতে শর্মিলা ছাড়া আর কাউকে কাস্ট করার কথা ভাবতে পারেননি সত্যজিৎ। একই সঙ্গে অরণ্যের দিনরাত্রি বা সীমাবদ্ধ। সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় একটি স্মৃতিচারণায় লেখেন, 'সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে প্রিয় ছবি বললে ওকে ‘দেবী’-র কথাই বলতে শুনেছি।
‘দেবী’ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রিঙ্কুদি বলেছিল, “সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েটির মুখ তোমায় তাড়া করে বেড়াবে। যদিও সে সময় আমার বয়স ছোট ছিল। কিন্তু বাংলায় বললে বেশ ‘পাকা’ ছিলাম। আমার মনে আছে ‘দেবী’র সেটে মানিকদা কাউকে অনুমতি দিতেন না আমার সঙ্গে কথা বলতে। ও রকম ভারি মালা পরে ধূপের সামনে দীর্ঘক্ষণ এক ভাবে বসে থাকতে হত সুব্রত’দার সামনে, যা গোটা জিনিসটাকে অপার্থিব করে তুলেছিল। মনে আছে, সেটে এক বার এক বয়স্ক ভদ্রলোক, মনে হয় কোনও জুনিয়র আর্টিস্ট, আমার সামনে শুয়ে পড়ে আমায় প্রণাম করতে শুরু করেন। যেন আমি সত্যিকারের দেবী!”
১৯৬৭ সালে শক্তি সামন্তের পরিচালনায় মুক্তি পায় 'অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস'। মুখ্য নারী চরিত্রে ছিলেন শর্মিলা। এই ছবিতে প্রথম কোনও হিরোইনকে মনোকিনি পরে সমুদ্রে স্কিয়িং করতে দেখে ভারতীয় সিনেমার দর্শকরা। এখানেই থেমে থাকেননি, বিকিনি পরে ফটোশুট করানোর সাহস দেখিয়েছিলেন শর্মিলা। আজ থেকে ৫৫ বছর আগে। এটা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। টাইম ম্যাগাজিন সে সময় শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে কভার স্টোরিও করে।
প্রেমকে মর্যাদা দিতে তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক মনসুর আলি খান পতৌদি বা টাইগার পতৌদির সঙ্গে বিয়ে করেন শর্মিলা। অনেকেই সে সময় বলেছিলেন, এ বিয়ে টিকবে না। কিন্তু কালের গণ্ডি টপকে সেই সম্পর্ক আরও অটুট। পতৌদি পরপাড়ে চলে গিয়েছেন বহু দিন। কিন্তু তাঁর ঘরণি হয়েই স্বতন্ত্র শর্মিলা।
স্টার হয়েও রীতিমতো মাটিতে পা রেখএই চলতেন শর্মিলা। তার উদাহরণ মেলে সন্দীপ রায়ের কলমে। তিনি লেখেন, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র শ্যুট হয়েছিল গরমকালে। পালামৌয়ের যে অরণ্যে শ্যুটিং হয়েছিল, সেই সিপাডহর নামের জায়গাটায় এক মাস পুরো ইউনিটকে থাকতে হয়েছিল। গরমে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! শর্মিলা ঠাকুর তখন বড় তারকা। ওই গরমের মধ্যেও কী অনায়াসে তিনি শ্যুট করতেন। কোনও অভিযোগ নেই। বরং পুরো দলের সঙ্গে শ্যুটিং বাদ দিয়ে বাকি সময় দেদার আড্ডা দিতেন। প্রবল গরমে ওঁরা নিজেদের নাম বদলে ফেলেছিলেন। ‘রবি-পোড়া’ (রবি ঘোষ), ‘শমিত-ভাপা’ (শমিত ভঞ্জ) এমন সব নামে পরিচয় দিতেন।'
আরও একটি বিষয় না বললেই নয়। দীর্ঘ বলিউড কেরিয়ার। একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়েও পুরোদস্তুর বাঙালি থেকে গিয়েছেন শর্মিলা। তাঁর কথা থেকে মাতৃভাষার টান কোনও দিন মুছে যায়নি। ২ বারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী এটা বার বার বুঝিয়ে যান, মাতৃভাষার টান এড়ানো খুব মুশকিল।
কৃতজ্ঞতা:
আনন্দবাজার পত্রিকা
ইন্টারনেট