scorecardresearch
 

তালিবানি মুখোশ খুলে ঝাঁঝরা হয়েছিলেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

৫-৬ জন পশুর নিরন্তর আক্রমণ চলছে। হাত দিয়ে টেনে মাথার চুল পর্যন্ত উপড়ে নিয়েছে ওরা। রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে, লাথি-ঘুসি চলছে। তবুও ওরা যেমনটা বলছে তার সঙ্গে একমত হননি সুস্মিতা। এর পর ২০ বার গর্জে উঠেছে কালাশনিকভ রাইফেল। তার পর শান্ত। শান্তি।

Advertisement
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হাইলাইটস
  • সুস্মিতা বলতেন, 'আফগানিস্তানের মহিলারা কী ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছেন, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমি একদিন গিয়ে তাঁদের মুক্ত করব।'
  • এক সময় হাতে কালাসনিকভ রাইফেল তুলে নিয়ে তালিবদের রীতিমতো হুমকিও দিয়েছেন তিনি। ছোটখাটো চেহারার এক ভারতীয় মহিলার তেজে সে সময় বীর তালিব পুঙ্গবরা গুটিয়ে ছিল।
  • এই সময় তিনি দেখেছেন, গোঁড়া তালিবানি শাসনের নির্লজ্জ বহুগামীতা। ধর্মের নামে ভয়ংকর অত্যাচার এবং এদের আচরণ একটা গোটা সম্প্রদায়ের মানুষকে সারা বিশ্বের চোখে ছোট করে দিয়েছে।

২০১৩ সাল। ৪ সেপ্টেম্বর। আফগানিস্তানের পাকতিকায় বেশ ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে। ঘরে হাত পা বাঁধা জাঁবাজ চিৎকার শুনছেন। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে গোঙানি। বার বার ডাকছেন, সাহেব কামাল... সাহেব কামাল। ওরা যা বলছে মেনে নাও... মেনে নাও...। অর্ধ শতাব্দী পার করে ফেলা সাহেব কামাল ওরফে সুস্মিতা শুনতে পাননি সেই গোঙানি। ৫-৬ জন পশুর নিরন্তর আক্রমণ চলছে। হাত দিয়ে টেনে মাথার চুল পর্যন্ত উপড়ে নিয়েছে ওরা। রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে, লাথি-ঘুসি চলছে। তবুও ওরা যেমনটা বলছে তার সঙ্গে একমত হননি সুস্মিতা। এর পর ২০ বার গর্জে উঠেছে কালাশনিকভ রাইফেল। তার পর শান্ত। শান্তি। চির শান্তিতে চলে গেলেন কলকাতা থেকে আগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাকে বিয়ে করা বাঙালি মেয়ে সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুস্মিতা বলতেন, 'আফগানিস্তানের মহিলারা কী ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছেন, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমি একদিন গিয়ে তাঁদের মুক্ত করব।' মুক্ত আর করা হল না। তিনি নিজেই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।

ঘটনা খানিকটা রিওয়াইন্ড করে ফিরে যান ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে। চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে লম্বা সুপুরুষ আফগান যুবক জাঁবাজ খান-কে বিয়ে করেন সুস্মিতা। বাড়িতে বাবা-মায়ের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন। ব্রাহ্মণ হয়ে মুসলমানকে বিয়ে করা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে যান শহর ছেড়ে। সুস্মিতাও শহর ছাড়েন জাঁবাজের সঙ্গে। তিনি চলে আসেন শ্বশুরবাড়ির মুলুক আফগানিস্তানে। কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে। জেদি। এই একটা শব্দ সুস্মিতার ক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে উপযুক্ত বিশেষণ।

যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত আদেশে পালিয়ে এসেছিলেন স্বামীর হাত ধরে, সেই স্বপ্নও ক্ষণস্থায়ী ছিল। যে মানুষটিকে বিশ্বাস করে তিনি ঘর, পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে বিদেশে এক কথায় চলে এসেছিলেন, সেই জাঁবাজ-ও মিথ্যে বলেছিলেন সুস্মিতাকে। প্রথম স্ত্রী গুলগুটি থাকা সত্ত্বেও সুস্মিতাকে বিয়ে করেন জাঁবাজ। শুধু স্ত্রী নয়, সন্তানও ছিল জাঁবাজের। আফগানিস্তানে গিয়ে এ সব জানতে পেরে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন সুস্মিতা। নিজের কষ্ট ভুলতে চেয়েছিলেন সেখানকার দুর্দশাগ্রস্ত মেয়েদের সাহায্য করে। চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু বই এবং কিছু হাতে কলমে শিক্ষা ছিল তাঁর। তাই দিয়েই মেয়েদের চিকিৎসা শুরু করলেন। আপন করে নিয়েছিলেন গুলগুটি ও তাঁর মেয়েকে।

Advertisement

তবে বছর খানেকের মধ্যেই তালিবানি শাসন শুরু হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। মনগড়া শরিয়তি আইন দেখিয়ে নারী জাতিকে কী ভাবে দিনের পর দিন বে-ইজ্জ়ত করা হয়েছে তা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। শুধু দেখেননি, প্রতিবাদও করেছেন সময়ে সময়ে। তার শাস্তিও পেতে হয়েছে তাঁকে। আফগানিস্তানে যাওয়ার পর তাঁর নতুন নাম হয় সাহেব কামাল। এ নামেই তাঁকে ডাকতেন জাঁবাজের আত্মীয় স্বজন। তবে শুধুমাত্র জাঁবাজের মুখ চেয়ে পড়ে ছিলেন পাণ্ডবর্জিত দেশে। যেখানে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরতে গেলেও পুরুষ সঙ্গী থাকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গী কেবল রক্তের সম্পর্কের কেউ হতে পারবেন। জাঁবাজ একদিন কিছু না জানিয়ে ফিরে যান ভারতে। একা পড়ে থাকেন সুস্মিতা। শুরু হয় শ্বশুরবাড়িতে তাঁর তালিবানপন্থী দেওয়রদের অত্যাচার।

এই সময় তিনি দেখেছেন, গোঁড়া তালিবানি শাসনের নির্লজ্জ বহুগামীতা। ধর্মের নামে ভয়ংকর অত্যাচার এবং এদের আচরণ একটা গোটা সম্প্রদায়ের মানুষকে সারা বিশ্বের চোখে ছোট করে দিয়েছে। অত্যাচারিত হয়েও তিনি বহুবার রুখে দাঁড়িয়েছেন এ সব অন্যআয়ের বিরুদ্ধে। দমে যাননি কখনও। শুধু নিজের জন্যে নয়, সেই সমস্ত মহিলাদের জন্য যাঁরা নিজের হয়ে কথা বলতে পারতেন না।

এখানেই শেষ নয়, সুস্মিতার প্রতিবাদী চরিত্র দেখে বাড়িতে একপ্রকার ঘরবন্দি করে রাখেন। সেখান থেকেও ২ বার পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়েন। গোপনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালিয়ে যেতে থাকেন এর মধ্যে। তবে তালিবানিরা সেটা জানতে পেরে একদিন আচমকা এসে সুস্মিতাকে প্রচণ্ড মারধর করে। ভেঙে ফেলে সমস্ত সরঞ্জাম। তালিবানিদের বর্ণিত ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য ১৯৯৫ সালে সুস্মিতাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে তালিবানি জঙ্গিরা। জেদি সুস্মিতা তালিবানের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসেন কাবুল। এক সময় হাতে কালাসনিকভ রাইফেল তুলে নিয়ে তালিবদের রীতিমতো হুমকিও দিয়েছেন তিনি। ছোটখাটো চেহারার এক ভারতীয় মহিলার তেজে সে সময় বীর তালিব পুঙ্গবরা গুটিয়ে ছিল। সেখান থেকে নকল পাসপোর্ট জোগাড় করে ভারতের ভিসা নিয়ে চেপে বসেন দিল্লির বিমানে।

ফিরে এসে তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতা বই আকারে প্রকাশ করেন তিনি। ২০০৩ সালে তাঁর কাহিনি নিয়ে সিনেমাও তারি হয় বলিউডে। এসকেপ ফ্রম তালিবান। সিনেমায় সুস্মিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মনীষা কৈরালা। ভারতে ফিরে আসার পর হাইল্যান্ড পার্কের কাছে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন সুস্মিতা। সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন জাঁবাজ-ও। তবে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্ল্যাট বিক্রি করে নাগেরবাজারে ডায়মন্ড সিটিতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন সুস্মিতা। ১৮ বছর কলকাতায় কাটিয়েছেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি বই লেখেন তিনি। ২০১৩ সালে ফের একবার আফগানিস্তানে ফেরার কথা ভাবেন। তাঁর শুভাকাঙ্খীরা অনেকবার তাঁকে বারণ করেন। কলকাতায় থাকাকালীনও হুমকি পেতেন সুস্মিতা। তবে তিনি যে ধারুতে গড়া ছিলেন, ওসব কোনও দিন পরোয়া করেননি।

শেষ পর্যন্ত চলেই গিয়েছিলেন ময়দার মতো মিহি ধুলোমাখা সেই গ্রামে, যেখানে বিয়ের পর জাঁবাজ তাঁকে এনে তুলেছিলেন। সেই আসাই শেষ আসা। পায়ে পায়ে মৃত্যু টেনে নিয়ে গিয়েছিল আঙুর, শসা, বাদাম, তরমুজের খেতে ভরা সেই স্মৃতি মাখা গ্রামে। যেখানে পরম যত্নে আফগান মহিলাদের সেবা করতেন সুস্মিতা। তামিবান নিয়ে তাঁর বিভিন্ন বইয়ে বার বার ধর্মের নামে বর্বরতাকে তুলে ধরেছেন তিনি। সেটাই কাল হল। সুস্মিতাকে শুধু হত্যাই করেনি জঙ্গিরা। রীতিমতো অত্যাচার করে ২০টা গুলি মেরেছিল তাঁকে। বোধহয় শিক্ষা দিতে চেয়েছিল সমস্ত নারী জাতিকে। যে জাতির হাত ধরেই এরা পৃথিবীর আলো দেখেছিল।

Advertisement

 

Advertisement