উত্তম কুমারের হাতে উত্তম-মধ্যম মার জুটেছিল বাহুবলীদের। নায়ক নিজেও কিছুটা আহত হয়েছিলেন। যদিও তখন তিনি নায়ক হননি। ১৯৪৬ সাল। সারা দেশ তখন সামাপ্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে। খোদ শহর কলকাতার বুকেও বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন ২০ বছরের যুবক উত্তম। নিয়মিত ব্যায়াম করেন, মুগুর ভাঁজেন। সেই সময়ের কলকাতা কেমন দেখেছিলেন, সবই তুলে ধরেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী 'আমার আমি'তে। যার বেশ কিছু নির্বাচিত অংশ নবকল্লোল পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। পরে পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশ করা হয়।
বইয়ে স্মৃতিচারণে উত্তম লেখেন তখন কলকাতার কী পরিস্থিতি ছিল। তিনি লেখেন, 'দেশের রাজনৈতিক তপ্ত আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে তখনও আমরা এগিয়ে চলেছি। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমাদের চারদিকে সন্ত্রাস। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ভারতকে মুক্ত করবার জন্য জননেতারা তখন মরিয়া। সবারই মাতৃমুক্তিপণ। অশান্তির শেষ নেই। গোটা শহরে আজ বিক্ষোভ, কাল হরতাল। চারদিকে কেমন যেন একটা চাপা আগুন। আগস্ট মাসে সেই আগুন যেন বাড়তে থাকল। ব্রিটেনের ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এসেছে, ভারতের স্বায়ত্তশাসনে সাড়া দিয়ে। তাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লিগের প্রাদেশিক শাখা কলকাতায় শুধু নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গে হরতাল ডাকল।
হরতাল মোটামুটি সার্থক হলো বটে, কিন্তু ষোলোই আগস্ট কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হলো দুপুরবেলা থেকে। দেখতে দেখতে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। চারদিকে শুধু খুন আর খুন। শহরের পথে পথে শুধু মানুষের রক্তের নদী। আকাশে শকুন। গোটা শহরটা স্তব্ধ। আমরা বাড়ি থেকে বেরুতে পারছি না কেউ। সিনেমা-থিয়েটার বন্ধ। আমরা পাড়ার বন্ধুরা এই হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময় কোমর বেঁধে রিলিফের কাজে নেমে পড়লাম। আমরা অনেক মানুষকে তখন নানাভাবে সাহায্য করেছি।
মাসখানেক পর দাঙ্গা অনেকটা স্তিমিত হলো বটে কিন্তু তবুও আতঙ্ক মুছে গেল না। হিন্দু-মুসলমান কেউ সহজ হতে পারছে না। ১৯৪৬ সাল গেল। চলে গেল ১৬ই আগস্টের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ইতিহাসের পাতায় রক্তের আলপনা এঁকে রেখে! ১৯৪৭ সাল এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে আর এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে আমার প্রিয় গায়ক সায়গল মারা গেলেন! এই সালের ২৬শে মার্চ থেকে আবার হিন্দু-মুসলমানের ভয়ঙ্কর দাঙ্গা আরম্ভ হলো। চতুর্দিকে শুধু মৃতদেহ। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার। মে মাসে বেলেঘাটা তালতলা অঞ্চল মিলিটারি নিয়ে নিল।
এল সেই দিন। কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন হারিয়ে গেল। ৩রা জুন ব্রিটেন ঘোষণা করল, ভারত আর পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা। ভারত দ্বিখণ্ডিত হলো, আর ২০শে জুন বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হলো। ভারতবাসীর সেই চরম দুঃখের দিন, আমরা দু’চোখে দেখলাম। সে এক চরম মানসিক অস্থিরতা-অসুস্থতা আমাদের। এর মধ্যে আমরা আবার রিলিফ দিলাম। খিচুড়ি রান্না করে আমরা খাওয়াতাম। তার মধ্যে আমার রক্তে আগুন জ্বলত। একদিন একটি গান লিখলাম আমি। সেই গান আমরা গেয়ে গেয়ে পাড়া পরিক্রমা করলাম। সেই গানের সুরও দিয়েছিলাম আমি। পরে সেই গান অনেক জায়গায় আমাকে শোনাতে হতো।
গানটি ছিল এরকম -
'হিন্দুস্তান মে কেয়া হ্যায় তুমারা
ও ব্রিটিশ বেচারা
আভি চলি যাও ইংল্যান্ড বাজা কর ব্যান্ড
মন্দির মসজিদ মে পূজা আরতি
মসজিদ মে শুনো আজান পূকার্তি
দিলছে দিলাও দিল হিন্দু মুসলমান
সারি হিন্দুস্তান মে আয়ি তুফান
গরিবোঁকে দুখো কি হোগি আসান।'
এরই মধ্যে কলকাতার রাস্তায় একটু রাত বাড়লে কিছু অবাঙালি ট্যাক্সি চালকের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। পুরুষ-মহিলা কেউই এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। জোর করে টাকা আদায়, মহিলাদের শ্লীলতাহানি এ সব করা নেহাতই মামুলি বিষয় ছিল তাদের কাছে। খবর যায় উত্তমের কাছে। তিনি ঠিক করেন, এদের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি সঙ্গে কয়েকজন বাছা বাছা বন্ধুদের নিয়ে সেই সব রাস্তায় ঘুরতে লাগলেন রাতে। এমনই এক রাতে শেষমেশ সেই বাহুবলীদের দেখা মিলল। উত্তমের পথ আটকে তারা জোর করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু উত্তমরা তৈরি হয়েই এসেছিলেন। বেদম মারে বাহুবলীদের সিধে করে ফিরেছিলেন সে দিন। তবে উত্তম নিজেও কিছুটা আহত হয়েছিলেন সে দিন। তবে শোনা যায়, এর পর থেকে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করেনি সেই ট্যাক্সিচালকরা।