scorecardresearch
 

Suraiya: পালানো, খুনের হুমকি - এমনই ছিল দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রেমকাহিনি

সেই থেকে শুরু। এমন গভীর প্রেম ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে বিরল। সবচেয়ে বড় কথা, তৎকালীন সমাজিক গোড়ামির কোনও পরোয়া করেননি দুজনে। সাক্ষাৎকারে যখনই এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, তাঁরা সব সময় উত্তর দিয়েছেন মন খুলে। কারণ প্রেমটা তাঁরা জুটি বাঁধার জন্য বা স্টেটাস মেন্টেন করার জন্য করেননি। একে অপরের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা এবং সম্মান ছিল তাঁদের মনে।

Advertisement
সুরাইয়া সুরাইয়া
হাইলাইটস
  • প্রেমের শুরু প্রাণ বাঁচানো থেকে আর শেষ... শেষ হয়নি।
  • পরিণতি পায়নি দেব আনন্দ এবং সুরাইয়ার প্রেম কাহিনি। যদিও তাঁরা চেষ্টা ত্রুটি রাখেননি।
  • সমাজ-পরিবার-লোকলজ্জার বিরুদ্ধে গিয়ে সকলে নিজেদের প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে পারেন না। যেমন পারেননি সুরাইয়া।

প্রেমের শুরু প্রাণ বাঁচানো থেকে আর শেষ... শেষ হয়নি। পরিণতি পায়নি দেব আনন্দ এবং সুরাইয়ার প্রেম কাহিনি। যদিও তাঁরা চেষ্টা ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু সব সময় ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলে না। ভাগ্যের সঙ্গে অবশ্য খানিকটা মনের জোরও প্রয়োজন হয়। সমাজ-পরিবার-লোকলজ্জার বিরুদ্ধে গিয়ে সকলে নিজেদের প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে পারেন না। যেমন পারেননি সুরাইয়া। দেব আনন্দ যদিও সব রকম চেষ্টা করেছিলেন।

ভারতীয় সিনেমার যাঁরা ভক্ত তাঁদের সুরাইয়া সম্পর্কে আলাদা করে বলার কিছু নেই। ৪০ এবং ৫০-এর দশকে সুরাইয়ার রূপ এবং গানে গোটা দেশ উদ্বেলিত ছিল। জন্ম ১৯২৯ সালের ১৫ জুন লাহোরের গুজরানওয়ালাতে। তাঁর পুরো নাম সুরাইয়া জামাল শেখ। ছোট থেকে অসাধারণ গানের গলা ছিল তাঁর। আর অসম্ভব ফটোজেনিক মুখশ্রী। ১৯৩০-এর দশকে মুম্বইয়ে চলে আসে তাঁর পরিবার। মাত্র ৭ বছর বয়সে শিশু শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ম্যাডাম ফ্যাশন সিনেমায়। পরিচালক ছিলেন জদ্দানবাই হুসেন। একই সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসাবে গানও করছিলেন। কে এল সায়গল সুরাইয়া-র গানে এতটাই মুগ্ধ হন, ১৬ বছর বয়সে তাঁর ছবি তদ্বির-এর হিরোইন করেন সুরাইয়াকে।

১৪ বছর বয়স থেকে হিরোইনের চরিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন সুরাইয়া। কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতীয় সিনেমায় হাইয়েস্ট পেইড শিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ৪০-এর দশকের শেষ দিকে দেব আনন্দ তখন সিনেমায় নিজের পা জমানোর চেষ্টা করছেন। তত দিনে সুরাইয়া সুপারস্টারের তকমা পেয়ে গিয়েছেন। সুরাইয়ার সঙ্গে দেব আনন্দের প্রথম ছবি বিদ্যা ১৯৪৮ সালে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়েন দেব। কিন্তু সুরাইয়ার মনে তখন সে বিষয়ে কোনও অনুভূতি ছিল না। কিন্তু বিধাতা মুচকি হাসছিলেন। ছবিতে নৌকার উপর একটি গান 'কিনারে কিনারে চলে জায়েঙ্গে'-র শুটিংয়ে হঠাৎ নৌকা গেল উল্টে। সুরাইয়া সাঁতার জানতেন না। নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে দেব ঝাঁপিয়ে পড়েন জলে। প্রাণ বাঁচান সুরাইয়ার।

Advertisement

সেই থেকে শুরু। এমন গভীর প্রেম ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে বিরল। সবচেয়ে বড় কথা, তৎকালীন সমাজিক গোড়ামির কোনও পরোয়া করেননি দুজনে। সাক্ষাৎকারে যখনই এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, তাঁরা সব সময় উত্তর দিয়েছেন মন খুলে। কারণ প্রেমটা তাঁরা জুটি বাঁধার জন্য বা স্টেটাস মেন্টেন করার জন্য করেননি। একে অপরের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা এবং সম্মান ছিল তাঁদের মনে। ঘটনার বহু বছর পর একটি সাক্ষাৎকারে সুরাইয়া বলেন, 'দেব আনন্দের ব্যক্তিত্বের সাদাসিধে দিকটাই আমায় আকৃষ্ট করেছিল। যে দিন নৌকার দুর্ঘটনা ঘটে, আমি দেবকে বলেছিলাম, তুমি যদি না বাঁচাতে, আজ আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। শুনে দেব বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন শেষ হলে তার সঙ্গে আমারটাও শেষ হয়ে যেত।'

এক বছরের মধ্যে সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছায় তাঁরা ঠিক করেন, পরিবারের অমতেই বিয়ে করবেন। অমত মূলত ছিল সুরাইয়ার পরিবারে। আরও স্পষ্ট করে বললে, তাঁর দিদা এই সম্পর্কের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এর পিছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথম পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন সুরাইয়া। তাও নেহাত কম রোজগার নয়। সে সময় লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেছেন সুরাইয়া। দ্বিতীয়ত ভিন ধর্মে সম্পর্ক। যদিও সুরাইয়া এ সব নিয়ে তখন ভাবিত ছিলেন না। তাঁর বাবা-মায়েরও এ সম্পর্কে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিদিমার সামনে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।

১৯৪৯ সালে ‘জিৎ’ ছবির শুটিংয়ের সময় পালিয়ে গিয়ে বিয়ের করবেন বলে ঠিক করেছিলেন দেব-সুরাইয়া। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহ-অভিনেত্রী দুর্গা খোটে। কিন্তু ছবির এক সহ-পরিচালক এই খবর জানিয়ে দেন সুরাইয়ার বাড়িতে। তাঁর দিদিমা এসে সেট থেকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুরাইয়াকে। ১৯৫০ সালে মুক্তি পায় তাঁদের ছবি ‘নীলি’। শুটিং সেটে সুরাইয়াকে আরও একবার বিয়ের প্রস্তাব দেন দেব আনন্দ। তখনকার দিনে ৩ হাজার টাকার হিরের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন সুরাইয়ার আঙুলে। পালিয়ে গিয়ে বিয়েতেও কোনও আপত্তি ছিল না তাঁর। কিন্তু সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে রাজি হননি সুরাইয়া। রাগে জ্ঞান হারিয়ে প্রেমিকাকে চড় মেরেছিলেন দেব আনন্দ। বলেছিলেন, ‘তুমি ভীতু ও কাপুরুষ।’

একটি সাক্ষাৎকারে সুরাইয়া বলেন, 'দেব তখন আমার বার বার বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, আর আমি বার বার না করে দিচ্ছি। রাগে ও আমায় কাপুরুষ বলেছিল। হয়তো আমি তাই ছিলাম। আমি স্বীকার করছি সে সাহস তখন আমি দেখাতে পারিনি। হয়তো এটা আমার বড় ভুল ছিল, হয়তো ভাগ্য ছিল।' তার সঙ্গে অবশ্যই ভয়ও ছিল। কারণ তাঁর মামা রাগের মাথায় বহুবার দেব আনন্দকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলেন সুরাইয়ার সামনে। সম্পর্ক রাখলে যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত, তবে নিজেকে কোনও দিন মাফ করতে পারতেন না সুরাইয়া।

এক সহ-অভিনেত্রী কামিনী কৌশলের মাধ্যমে দেবের হাতে চিঠি পাঠাতেন সুরাইয়া। দেবের জবাবও তাঁর কাছে পৌঁছাত কামিনীর হাত ঘুরে। ১৯৫১ সালে তাঁদের শেষ ছবি সনম মুক্তি পাওয়ার পর আর বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হত না। দিদিমার কড়া নির্দেশ ছিল, দেব আন্দের সঙ্গে আর কোনও ছবিতে অভিনয় করা যাবে না। তবে বাড়ির ছাদে লুকিয়ে দেখা করতেন তাঁরা। ব্যবস্থা করে দিতেন সুরাইয়ার মা। এ ভাবেই বাড়ির ছাদে শেষবার দেখা করেছিলেন দেব-সুরাইয়া। বিরহে কাতর দেব-কে তখন অভিনয় নিয়েইএগিয়ে যেতে পরামর্শ দেন দাদা চেতন আনন্দ।

Advertisement

আরও একটি বিষয় না লিখলে প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দেব আনন্দ-কে ভারতীয় সিনেমার গ্রেগরি পেক বলা হয়। কিন্তু দেব গ্রেগরি-কে কেন অনুকরণ করা শুরু করেন জানেন? কারণ সুরাইয়ার সবচেয়ে পছন্দের অভিনেতা ছিলেন গ্রেগরি। ১৯৫৪ সালে দেব সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলেও চিরকাল অবিবাহিত থেকে গিয়েছেন সুরাইয়া। জীবনের শেষ দিকে তিনি সম্পূর্ণ একাই কাটিয়েছেন। তিনি কতটা একা ছিলেন তাঁর একটি জবাব বলে দেবে। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করা অভিনেত্রী তবস্সুম একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, 'দিদি কেমন আছেন?' উত্তরে সুরাইয়া বলেন, 'ক্যায়সি গুজর রহি হুঁ সভি পুছতে হ্যায়, ক্যায়সে গুজারতি হুঁ কোই নেহি পুছতা।' অর্থাৎ, কেমন আছি সে কথা সকলেই জিজ্ঞাসা করে, কী ভাবে দিন কাটাই সে কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে না।

এ ভাবে একলাই ৭৫ বছর বয়সে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন। পূর্ণতা পায়নি তাঁর প্রেম। পূর্ণতা পেতে পারত তাঁর কেরিয়ার-গায়কি। হল না।

 

Advertisement