ভারতীয় সঙ্গীতে, বিশেষত ফিল্ম সঙ্গীতে যে সমস্ত মানুষের নাম প্রাতঃস্মরণীয়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁদের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে থাকবেন। তাঁর অমর সৃষ্টি মহিষাসুরমর্দিনী প্রত্যেক বাঙালির কাছে নিখাদ আবেগ ছাড়া আর কিছু নয়। ৯০ বছর ধরে আজও মহালয়ার ভোরে বাঙালির ঘুম ভাঙে 'ইয়া চণ্ডী... মধুকৈটভারী...' শুনে। যাঁর সুর মূর্ছনাতে এই অপার্থিব সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি কালের নিয়মে ধীরে ধীরে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন। ১১৬তম জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে না আছে কোনও অনুষ্ঠান, না হল আলোচনা।
১৯০৫ সালে কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম পঙ্কজ মল্লিকের। ছোট থেকে মায়ের উৎসাহে গানের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। সেটাই একটু বড় বয়সে গিয়ে দাঁড়ায় প্যাশনে। ১০০ বছর আগে ছেড়ে দেওয়া যাক, আজকের দিনেও সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে যদি কোনও সন্তান বলে গান করে জীবিকা নির্বাহ করবেন, তা হলে এখনও পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু পঙ্কজ অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন। নিজের প্রতি অগাধ আস্থা, কাজের প্রতি বিশ্বাস এবং জেদ, এই তিন সঙ্গীতে নিয়ে তিনি সঙ্গীত চর্চায় জীবন অতিবাহিত করবেন বলে স্থির করেন। তখন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তামিল চলছে। পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ জন্মায় তাঁর।
এর জন্য অবশ্য দায়ী দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলেজে পড়াশোনা করার সময় ঠাকুর পরিবারের এই সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় পঙ্কজের। তাঁর সাহচর্যেই কবিগুরুর গানের প্রতি অসীম টানে ভেসে গিয়েছেন। বলা যায় মধ্যবিত্ত বাঙালির গানের আসর থেকে সাধারণের মধ্যে রবীন্দ্র গানকে ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে তাঁর সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তাঁর সুরক্ষেপন এবং গায়কিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, জীবদ্দশায় যে সব গানে তিনি সুর করে যেতে পারবেন না, সেগুলিতে সুর করার দায়িত্ব যেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিগুরুর এই আশীর্বাদকে তিনি সব পুরস্কার ও সম্মানের ঊর্ধ্বে মনে করেছেন। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তিনিই প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেছিলেন।
এ তো গেল তাঁর জীবনের একটি অধ্যায়। ভারতীয় সিনেমা, বাংলা, হিন্দি, তামিল, উর্দু মিলিয়ে বহু ছবিতে তাঁর দেওয়া সুর সারা দেশকে মাতোয়ারা করেছে। কুন্দনলাল সেহগল বা কে এল সেহগল ছিলেন তাঁর অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। পঙ্কজের সুরে অবিস্মরণীয় সমস্ত গান গেয়েছেন সেহগল সাহেব। একবার রেকর্ডিংয়ে মদ্যপ অবস্থায় গান গাইতে এসেছিলেন সেহগল। কিছুতেই ঠিকঠাক সুরে গাইতে পারছেন না। সেহগলের তখন বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, মদ না খেলে তিনি গান করতে পারবেন না। তত ক্ষণে অবশ্য পঙ্কজ বুঝে গিয়েছেন তাঁর বন্ধু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। স্টুডিও ভরতি মানুষের মাঝে সেহগল-কে ঠাসিয়ে এক চড় মারেন পঙ্কজ মল্লিক। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেহগল। তার পরের টেকে একেবারে ওকে। গানটি ছিল মাই সিস্টার ছবির, 'অ্যায় কাতিবে তকদির মুঝে ইতনা বতা দে...'।
প্রমথেশ বড়ুয়ার চাপাচাপিতে সিনেমায় অভিনয়ও শুরু করেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়েও যে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর একের পর এক সিনেমায় মুখ দেখানো। যদিও অভিনয়কে তিনি তেমন ভাবে কোনও দিনই আমল দেননি। তাঁর মন বাঁধা পড়েছিল সাত সুরের স্বরলিপিতে। ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে তাঁকে বম্বে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বহু নামকরা পরিচালক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজ কাপুরও। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে তিনি কোনও দিন যেতে চাননি। সে কারণেই কলকাতায় এসে অনেকে তাঁর সুরে গান রেকর্ড করিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তাঁর নানা অনুষ্ঠান ভীষণ ভাবে শ্রোতাদের পছন্দের ছিল। তখন মহিলাদের বাড়ি থেকে খুব একটা বেরতে দেখা যেত না। ফলে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও গান শিখতে পারেননি। সেই ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন পঙ্কজ। রেডিওতে অনুষ্ঠান সঙ্গীত শিক্ষার আসর শুরু করেন তিনি। ভজন থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত সব কিছু অত্যন্ত যত্ন নিয়ে শেখাতেন তিনি। আর মহিষাসুরমর্দিনী-তো কাল্ট। তা নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা কজন দেখাতে পারেন! তবে রেডিওতে তাঁকে অপমানিতও হতে হয়েছে। একবার তাঁকে না জানিয়ে মহিষাসুরমর্দিনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে শ্রোতাদের প্রবল সমালোচনার কারণে সে বছরই ষষ্ঠীর দিন সকালে ফের একবার শোনানো হয়েছিল অনুষ্ঠানটি।
শেষ অপমানটাও বড় বেদনাদায়ক। যার উল্লেখ তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন। তিনি লেখেন, 'আসরে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছিলাম ‘তোমার শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’। … তখন কি জানতাম এই গানই আমার আসরের শেষ গান হয়ে দাঁড়াবে! … মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম। এমন সময় অকস্মাৎ এক দিন আমার বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। … অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। এক বোবা যন্ত্রণা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল।… যে মীরাবাঈ ভজনটি শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম সেটিকে, বলা বাহুল্য, শেষ হতে দেওয়া হল না।'
গানকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেও পদ্মশ্রী, দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার জেতা এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি শেষ জীবনে এত অপমানের সাক্ষী থাকবেন, তা হয়তো তিনি নিজেও ভাবেননি।