
বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ভারতে খেলা মানে একটি আবেগ। উত্তেজনা, আনন্দ, রোমাঞ্চ। কিন্তু কখনও কখনও এই খেলাই নিয়ে আসে শোকের ছায়া। আর খেলার আনন্দে মৃত্যু-মিছিলের নজির ভারতে অতীতেও রয়েছে। বুধবার বেঙ্গালুরুতে যা ঘটল, সেই ঘটনা মনে পড়াচ্ছে ১৯৮০ সালের একটি ভয়াবহ দিনকে। আজকের প্রজন্মের অনেকেই সম্ভবত জানেন না। প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ইডেন সে দিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮০ সালে ইডেন গার্ডেন্সে যেমন ঘটেছিল, তেমনই ঘটনা ঘটল ২০২৫ সালের জুন মাসে বেঙ্গালুরু শহরে। দুটি ঘটনাই খেলাকে কেন্দ্র করে। প্রথমটিতে খেলার চলাকালীন ও দ্বিতীয়টিতে পছন্দের টিমের জয়ের উল্লাস।
১৯৮০-র সেই ভয়ঙ্কর দিন
১৬ অগাস্ট, ১৯৮০। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের খেলা। ভেন্যু কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। তখন সল্টলেক স্টেডিয়াম ছিল না। গ্যালারিতে প্রায় ৭০ হাজার দর্শক। খেলার মাঠে ঝামেলা হয় দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে। মোহনবাগানের বিদেশ বসু ও ইস্টবেঙ্গলের দিলীপ পালিতের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। উত্তেজনার আঁচ পৌঁছে যায় গ্যালারিতে। দর্শকরা পাথর ছোড়েন একে অপরের দিকে। পুলিশ পরিস্থিতি সামলাতে পারেনি। শুরু হয় হুড়োহুড়ি, পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ যায় ১৬ জনের। আজও সেই দিনটি ‘ফুটবলপ্রেমী দিবস’ নামে পরিচিত। তবে সেই দিন কেবল শোক আর অপ্রস্তুত ব্যবস্থাপনার দিন হয়ে রয়ে গেছে কলকাতার ইতিহাসে।
এবার বেঙ্গালুরু, ক্রিকেটের জয়োল্লাস ম্লান
৪ জুন, ২০২৫। আইপিএল-এ প্রথমবার ট্রফি জিতেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। দীর্ঘ ১৮ বছরের অপেক্ষার অবসান। বেঙ্গালুরু শহরজুড়ে উন্মাদনা। কিন্তু সেই উল্লাসই মুহূর্তে পরিণত হল কান্নায়। RCB-র জয় উদ্যাপন উপলক্ষে শহরের এমজি রোড, ব্রিগেড রোড, কাব্বন পার্ক এবং বিধান সৌধের আশপাশে ভিড় জমে লক্ষাধিক মানুষের। সবাই চায় এক ঝলক বিরাট কোহলিকে দেখতে। সেই ভিড়েই পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারালেন অন্তত ১১ জন।
অনেকে স্কুল পড়ুয়া, কেউ বা কলেজ ছাত্র, কেউ অফিসফেরত কর্মী—সবাই এসেছিলেন খুশি মনে। ওঁরা ভাবেননি, আর ফেরা হবে না। একটি পরিকল্পিত অনুষ্ঠান, অথচ মাত্র ২৪ ঘণ্টার প্রস্তুতি ছিল পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে। সেই প্রস্তুতি যে পর্যাপ্ত ছিল না, তা এবার স্পষ্ট।
একই ঘটনা, আলাদা শহর
১৯৮০-র কলকাতা হোক বা ২০২৫-এর বেঙ্গালুরু—উত্তেজনা, ভালোবাসা আর খেলাকে ঘিরে মানুষের আবেগ এক। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই আবেগকে সামলাতে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের প্রশাসন? কেন মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে শুধুমাত্র একটা খেলা ঘিরে উত্তেজনায়?
বিশ্বজুড়ে এমন ঘটনা নতুন নয়
ভারতের বাইরেও এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮৯ সালের হিলসবরো দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৯৭ জনের। ১৯৬৪-তে পেরুর লিমায় ফুটবল ম্যাচ ঘিরে মারা গিয়েছিলেন ৩০০-র বেশি মানুষ। খেলার মাঠে শুধু বল নয়, অনেক সময় গড়িয়ে পড়ে মানুষের প্রাণও। বেঙ্গালুরুর এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শুধু আবেগ দিয়ে ভিড় সামলানো যায় না। খেলার প্রতি ভালোবাসা যদি প্রশাসনের উদাসীনতার সঙ্গে মিশে যায়, তা হলে এমন বিপর্যয় অনিবার্য। এই ১১টি প্রাণ শুধু পরিসংখ্যান নয়—প্রতিটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের গল্প।