
বিগত মাস খানেক ধরে বঙ্গ ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমে (শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বলাটা বোধহয় ঠিক নয়) ঘোরা ফেরা করছে বাংলায় লেখা প্রেসক্রিপশন! এই বাংলা প্রেসক্রিপশনের সঙ্গেই একটা দাবিও মাঝে মধ্যে চোখে পড়ছে নেট দুনিয়ায়— ‘বঙ্গে প্রেসক্রিপশন লেখা হোক বাংলায়!’
মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (MCI) আগেই দেশ জুড়ে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চিকিৎসকদেরই প্রেসক্রিপশনে ব্র্যান্ড নামের পাশাপাশি বাধ্যতামূলক ভাবে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশ দিয়েছিল। একটা কথা কিছুদিন আগে পর্যন্ত খুব শোনা যেত, ‘ডাক্তারদের হাতের লেখা নাকি খোদ ডাক্তাররাই বুঝতে পারেন না!’ কিন্তু সে সমস্যাও এখন প্রায় অতীত! কারণ, প্রেসক্রিপশনে ইংরাজিতে বড় হাতের অক্ষরে (ক্যাপিটাল লেটারে) লিখছেন অধিকাংশ চিকিৎসকই। তাই লেখা বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছে না। তাহলে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার দরকার পড়ছে কেন!
বঙ্গে বাংলায় প্রেসক্রিপশনের পক্ষে যাঁরা সুর চড়াচ্ছেন তাঁদের যুক্তি হল, এ রাজ্যের সব মানুষ কি ইংরাজি লেখা পড়তে জানেন? যাঁরা ইংরাজি লেখা পড়তে জানেন না, তাঁরা কী করে বুঝবেন প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকের রোগীর প্রতি কী পরামর্শ লেখা রয়েছে?
এই প্রসঙ্গে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরিন্দম পাণ্ডে (Dr Arindam Pande) বলেন, “প্রেসক্রিপশনে রোগীর উদ্দেশ্যে লেখা পরামর্শের অংশটুকু রোগী ও তাঁর সঙ্গে থাকা পরিবারের সদস্যকে ভাল করেই বুঝিয়ে দেন সব ডাক্তার। বাকি রইল ওষুধের নাম। সে তো ওষুধের দোকানে যিনি বা যাঁরা ওষুধ দেবেন, তাঁদের জন্য। প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম বাংলায় লিখলে যাঁরা ওষুধের দোকানে ওষুধ দেবেন, তাঁদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে!” বাংলায় লেখার পরিবর্তে গোটা গোটা ইংরাজি হরফে (ক্যাপিটাল লেটারে) প্রেসক্রিপশন লিখলে সকলেরই সুবিধা হবে বলে মনে করেন ডাঃ পাণ্ডে।
বঙ্গে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার প্রসঙ্গে শিশু-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (চাইল্ড স্পেশালিস্ট) ডাঃ অনিন্দ্য কুণ্ডু (Dr Anindya Kundu) বলেন, “এখন বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক ভাষা সরকারি কাজে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই একটা দাবি রয়েছে যে, ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনটাও এবার প্রাদেশিক ভাষায় লেখা হোক! যেমন, পশ্চিমবঙ্গের রোগীদের জন্য বাংলাতে কেন লেখা যাবে না! সমস্যা একটাই। নানা ভাষার এই দেশে ইংরেজরা বুঝেছিলেন সারা দেশে সরকারি কাজ চালাতে ইংরেজি ভাষাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, প্রাদেশিক ভাষাকে গুরুত্ব দিলে ব্রিটিশদের এ দেশে প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতে সমস্যায় পড়তে হতো। তাই মূলত নিজেদের স্বার্থেই এ দেশে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে একমাত্র ইংরেজি ভাষার প্রয়োগের অভ্যাস ভারতীয়দের মজ্জাগত করে দিয়েছিল ইংরেজরা। সেই অভ্যাস সম্পূর্ণ ভাবে কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে কি? তাই প্রাদেশিক ভাষায় প্রেসক্রিপশন লেখা হলে হয়তো মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অবশ্যই সুবিধা হবে, তবে সমস্যায় পড়বেন অনেকেই! কেননা, শহরাঞ্চলে একজন চিকিৎসককে নানা ভাষার রোগীদেরই দেখতে হয়। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ও প্রায় সকলের বোধগম্য ভাষায় (যা দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে আদপে ইংরাজি) প্রেসক্রিপশন লিখলেই সকলে উপকৃত হবেন বলে আমার মনে হয়।”
তাহলে যে সমস্ত রোগী ইংরাজিতে লেখা প্রেসক্রিপশন বুঝতে পারবেন না, তাঁরা কোন ওষুধ কখন, কী ভাবে খাবেন? এই প্রসঙ্গে ডাঃ কুণ্ডু বলেন, “যে কোনও প্রেসক্রিপশন দেখে রোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্যের হাতে ওষুধ তুলে দেন ওষুধের দোকানের ফার্মাসিস্ট। বলে রাখা ভাল, প্রত্যেক ওষুধের দোকানেই একজন ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। রোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্যকে প্রেসক্রিপশনের খুঁটিনাটি তথ্য, কোন ওষুধ কখন, কী ভাবে খেতে হবে ইত্যাদি বুঝিয়ে দেওয়া দোকানের ফার্মাসিস্টের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। রোগীর বোঝার সুবিধার জন্য প্রয়োজনে ফার্মাসিস্ট ওষুধের খামের উপর লিখেও দিতে পারেন বা দেন, কোন ওষুধ কখন, কী ভাবে খেতে হবে! তাই ইংরাজিতে প্রেসক্রিপশন লিখলেও কোনও রোগীরই সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
বঙ্গে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ (মেডিসিন) চিকিৎসক ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাস (Dr Arindam Biswas) বলেন, “আমি মাঝে মধ্যেই রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলায় প্রেসক্রিপশন লিখে থাকি। তবে গোটা প্রেসক্রিপশন বাংলায় আমি লিখি না। শুধু প্রেসক্রিপশনে রোগীর উদ্দেশ্যে লেখা পরামর্শের অংশটুকুই বোঝার সুবিধার জন্য বাংলায় লিখি।”
কবে থেকে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লিখছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ বিশ্বাস বলেন, “বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার শুরু বছর পাঁচেক আগে। একবার হাসপাতালের বহির বিভাগে বাংলাদেশ থেকে আসা এক রোগীকে দেখতে গিয়ে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার অনুরোধ পাই। তিনি অনুরোধ করেন, বাংলায় লিখলে তাঁর বুঝতে সুবিধা হবে। সেই থেকে কখনও রোগীর অনুরোধে, কখনও নিজে থেকেই রোগীর সুবিধার্থে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লিখি।”
বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার প্রয়োজন কি আদৌ আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ বিশ্বাস বলেন, “অনেক চিকিৎসকই bdpc, bdac করে লিখে দেন। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের দোকানেও ঠিক মতো বুঝিয়ে দিতে পারে না| বাংলাতে লিখে দিলে ওষুধের দোকানের বিক্রেতার উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। আর বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখাটা নতুন কিছু নয়। মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে অনেক চিকিৎসকই বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখেন। সেখানে বাংলায় প্রেসক্রিপশন দেখে কারও কোনও সমস্যাও হয় বলে শুনিনি।”
বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার প্রসঙ্গে এসএসকেএম হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সুনন্দ দে (Dr Sunanda De) বলেন, “ডাক্তারি পড়াশুনো থেকে ওষুধপত্র— সবটাই তো ইংরাজিতে। তাই গোটা প্রেসক্রিপশন হয়তো বাংলায় লেখা সম্ভব নয়! তবে রোগীকে বোঝাতে প্রেসক্রিপশন পরামর্শের অংশটুকু বাংলায় লেখা যেতেই পারে। সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিপুল সংখ্যক রোগী দেখার চাপ সামলে প্রেসক্রিপশনে বাংলায় আলাদা করে লিখে বুঝিয়ে দিতে হয়তো সময় কিছুটা বেশি লাগতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ রোগী সঠিক ভাবে বুঝলে এবং মেনে চললে চিকিৎসার ফলও মিলবে দ্রুত। এটাই তো আসল উদ্দেশ্য!”
আসলে সবটাই অভ্যাস! শহরে ইংরাজিতে লেখা প্রেসক্রিপশন দেখতেই সকলে অভ্যস্ত। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখার চল রয়েছে। কোথাও কোনও দাবি বা জোর কোরে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসকরা রোগীর প্রয়োজন বুঝে তাঁর বোঝার মতো করে প্রেসক্রিপশন লিখলেই ভাষা কখনওই কোনও সমস্যা হতে পারে না, মেনে নিচ্ছেন প্রায় সকল চিকিৎসকই!