কাজের জন্য অনেককেই এখন বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকতে হয়। সেখানে মূলত ভাড়া বাড়িই তাদের ভরসা। প্রত্যেকেই নিজের আয়ের ওজন বুঝে, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার প্ল্যান করেন। কেউ বিলাসিতার দিকে যান, আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র মাথা গোজার জায়গা খোঁজেন। কিন্তু জানেন কি, আপনি যেমন ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালা কিছু শর্ত দেখায়, তেমনই আপনারও, ভাড়া নিয়ে কিছু অধিকার রয়েছে? ভাড়াটেরা কী কী অধিকার পান, জেনে রাখা জরুরি।
বাড়ি ভাড়া
দেশের মেট্রো শহরগুলিতে বর্তমানে বাড়ি ভাড়া হু হু করে বাড়ছে। মূলত সমস্ত অফিস কাছারিগুলি শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় জীবিকার প্রয়োজনে প্রচুর মানুষ শহরে এসে থাকছেন। প্রচুর মানুষ অন্য রাজ্য থেকেও নানা মেট্রো শহরগুলিতে জীবিকার প্রয়োজনে গিয়ে বাস করছেন। এমতাবস্থায় একমাত্র উপায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া। যে ব্যক্তি বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন তাকেও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এই মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে অধিকার, ন্যায্য ভাড়া দেওয়ার অধিকার এবং অন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি অ্যাক্সেস করার অধিকার।
রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট
এই অধিকারগুলি না জানলে নিজের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে ভাড়াটেদের। এমনকি নিপীড়নের শিকার হওয়াও আশ্চর্যের বিষয় নয়। রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্টের আওতায় ভাড়াটেরা কী কী অধিকার পান দেখে নেওয়া যাক।
বাসযোগ্য সম্পত্তিতে বসবাস করার অধিকার: যে বাড়িটিতে ভাড়াটে থাকছে, সেটিকে মানুষের পক্ষে বাসযোগ্য করার দায়িত্ব থাকে বাড়িওয়ালার উপর।
বাড়িওয়ালার পরিচয় জানার অধিকার: কোন ব্যক্তির বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকছেন, তা জানা একজন ভাড়াটের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
অন্যায্য ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: সাধারণ নিয়ম বলে একজন বাড়িওয়ালা বছরে ১১ মাস অন্তর ১০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারেন। কিন্তু অন্যায্য ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার রয়েছে ভাড়াটিয়াদের।
জোরপূর্বক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: কোনও ভাড়াটিয়া যদি মনে করেন তাকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তবে তার প্রতিবাদ করার অধিকার রয়েছে।
সিকিউরিটি মানি ফেরত পাওয়ার অধিকার: বর্তমানে সব বাড়িওয়ালারাই সিকিউরিটি মানি নেন। ভাড়াটেরা ভাড়ার মেয়াদ শেষে এই টাকা ফেরত নিতে পারেন।
নোটিশ পাওয়ার অধিকার: যদি বাড়ির মালিক ভাড়াটে তুলে দিতে চান, সেক্ষেত্রে ভাড়াটেরা নোটিশ পাওয়ার দাবি রাখেন।
এছাড়া সম্পত্তির এনার্জি পারফরমেন্স সার্টিফিকেট (EPC) দেখার অধিকার, সম্পত্তিতে নির্বিঘ্নে বসবাস করার অধিকার রয়েছে ভাড়াটিয়াদের।
লিখিত ভাড়াটে চুক্তি
আইন মোতাবেক, বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে বা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার আগে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়েরই উচিত অবশ্যই ১১ মাসের জন্য একটি লিখিত ভাড়াটে চুক্তি স্বাক্ষর করা। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়েরই স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। এছাড়া বাড়িটি যাতে বাসযোগ্য থাকে, সেদিকে নজর দেওয়ার দায়িত্ব থাকে বাড়িওয়ালারই। অর্থাৎ বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকে বাড়িওয়ালার উপরেই। বছরে একবার বাড়ির খোঁজ রাখাও উচিত বাড়িওয়ালার।
বাড়িওয়ালার সমস্যা
বাড়ির শখ প্রতিটি মানুষেরই থাকে। কিন্তু এমন অনেকেই রয়েছেন, যাদের নিজস্ব কোনও বাড়ি নেই। তারা দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে নিজের বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কর্মসূত্রে বা অন্য প্রয়োজনে অনেকেই কলকাতা, দিল্লি- মুম্বইয়ের মতো শহরে ভাড়া নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে অনেকেই সম্পত্তির মালিক বছরের পর বছর ভাড়াটেকে বাড়ি ভাড়া দেন। এক্ষেত্রে সতর্কতা না থাকলে কিছুটা হলেও বিপাকে পড়তে পারেন বাড়িওয়ালা।
বাড়ির কোনও খোঁজ খবর না রাখা
অনেক সময় দেখা যায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর আর বাড়ির সম্পর্কে কোনও খোঁজ খবর রাখছেন না বাড়িওয়ালা। এই প্রবণতা কিন্তু বিপদের কারণ হতে পারে। মাসে মাসে শুধুমাত্র ভাড়া গোনা মোটেই কাজের কথা নয়। অনেক সময় সম্পত্তির মালিক তা ভাড়া দেওয়ার পর বছরের পর বছর সেই সম্পত্তির আর কোনও রক্ষণাবেক্ষণ করেন না, এ আসলে বাড়িওয়ালারই ক্ষতি। এমন অবহেলার মাসুল বড় আকারে গুনতে হতে পারে।
একটানা ১২ বছর ধরে বাস
সম্পত্তির আইন মোটেই কোনও সহজ বিষয় নয়। তবে একটি জায়গায় বলা রয়েছে একটানা ১২ বছর ধরে একটি সম্পত্তিতে বসবাস করার পরে, ভাড়াটে ওই বাড়ির উপর নিজের অধিকার দাবি করতে পারে। যদিও দাবি করলেই যে তিনি বাড়ি পেয়ে যাবেন, তা মোটেই নয়। তবে এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তা বলাই বাহুল্য।
জমি দখলের আইন
এই দখলের আইন আসলে ব্রিটিশ আমলের। সহজ ভাষায় বলা হলে এটি আসলে জমি দখলের আইন। তবে এই আইন কিন্তু মোটেই সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। এ কারণে অনেক সময় মালিকদের সম্পত্তি হারাতে হয়। তাই বাড়িওয়ালাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
অ্যাডভারস প্রজেশন
এ বিষয়ে যে নিয়মটির কথা বলা হয়, সেটির আইনি নাম 'অ্যাডভারস প্রজেশন'। এর আওতায় কোনও ব্যক্তি যদি ১২ বছর ধরে জমির মালিকের সম্মতিতে জমির একটি অংশে বসবাস করেন, তবে তিনি জমির মালিকানা দাবি করতে পারবেন। কিন্তু তিনি দাবি করলেই যে ভাড়াটে মালিকানা পাবেন, এমন কোনও বিষয় নেই। লিমিটেশন অ্যাক্টের আর্টিকেল ৬৫ -এ দখলের বিষয়ে নীতি তুলে ধরা হয়েছে। 'অমরেন্দ্র প্রতাপ সিং বনাম তেজ বাহাদুর প্রজাপতি' মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই 'অ্যাডভারস প্রজেশন' -এর উল্লেখ করেছিল। এটা আসলে এমন একটা বিষয়, যখন জমির আসল মালিক অধিগ্রহণ করা পার্টিকে জমি থেকে সরাতে পারে না। ফলে ওই জমি থেকে মালিকানা হারায়।
আদৌ বাড়ির মালিকানা পায় ভাড়াটে?
যদি সম্পত্তিটি শান্তিপূর্ণভাবে অধিগ্রহণ করা হয় এবং জমির মালিকও এটি সম্পর্কে অবগত হন, তবে সেই অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পত্তির মালিকানা দাবি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে বাড়ির মালিক ১২ বছরে বাড়ির কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করেনি এবং এই ১২ বছর ওই সম্পত্তি একই ভাড়াটের দ্বারাই অধিগ্রহণ করা ছিল। দখলকারীরও সম্পত্তির দলিল, ট্যাক্সের রশিদ, বিদ্যুৎ বা জলের বিল, সাক্ষীদের হলফনামা ইত্যাদি প্রয়োজন। এরপর আদালতে গড়াবে মামলা।
বাড়িওয়ালাকে কী কী ভাবে সতর্ক থাকতে হবে?
বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে বাড়িওয়ালার উচিত একটি চুক্তি করা। ১১ মাসের জন্য এই চুক্তি করতে হবে। এছাড়া, সময়ে সময়ে ভাড়াটে পরিবর্তন করাও বুদ্ধিমানের মতো কাজ।