
মাইনে অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে ব্যালেন্স কমে ৭ টাকা। সম্প্রতি Reddit-এ এক ইউজারের করুণ আর্থিক পরিস্থিতির কাহিনি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তিনি লিখেছেন, তাঁর মাইনে ৪৩ হাজার টাকা। সেই টাকা অ্যাকাউন্টে ঢোকার পরে ৭ টাকা হতে সময় লাগে জাস্ট ৫ মিনিট। বাস্তবিক ভাবে এটাই বর্তমানে শহুরে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের অবস্থা। EMI-এর চাপে নগদ টাকা দেখতে পাচ্ছেন না অ্যাকাউন্টে। আপনারও কি এরকম অবস্থা হয়?
অ্যাকাউন্টে ঢোকার পরের ৫ মিনিটে কী কী ঘটে
ওই Reddit ইউজার জানিয়েছে, ৪৩ হাজার টাকা মাইনে তাঁর অ্যাকাউন্টে ঢোকার পরের ৫ মিনিটে কী কী ঘটে। তিনি জানাচ্ছেন, ১৯ হাজার টাকা ঘরভাড়া দেন, ক্রেডিট কার্ডে মিনিমাম ব্যালান্স পে করেন ১৫ হাজার টাকা, EMI দেন ১০ হাজার টাকা, মোবাই ও ওয়াই-ফাই বিল সহ ৩ হাজার ৭০০ টাকা। সব চুকিয়ে পড়ে থাকে ৭ টাকা। এই গোটা প্রক্রিয়াটি ঘটতে সময় লাগে ঠিক ৫ মিনিট।
একটি EMI দিতে গিয়ে আরেকটি লোন নিতে হচ্ছে
বস্তুত, ওই Reddit ইউজারের মতোই পরিস্থিতিতে রয়েছেন শহরাঞ্চলের বড় অংশের মধ্যবিত্তরা। এক কথায়, তাঁরা ঋণের জালে জড়িয়ে গিয়েছেন। ফলে যা-ই ঘটে যাক, আগে EMI দিতে হবে, এটাই তাঁদের মূল লক্ষ্য থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অনেক সময় কিছু অপ্রত্যাশিত খরচ হয়ে গেলে EMI দেওয়া চাপ হয়ে যায়। তখন আবার একটি ঋণ নিয়ে ফেলছেন। সংশ্লিষ্ট EMI চোকাতে গিয়ে আরেকটি EMI চালু হয়ে যাচ্ছে। ঋণের চক্রব্যুহে জড়িয়ে যাচ্ছেন। বেরনোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। ভারতে বছর দশেক আগেও এতটা খারাপ পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরাও।
ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৭৫ শতাংশ বেড়েছে
RBI-এর ডেটা বলছে, গত ৩ বছরে ভারতে পার্সোনাল লোন বা ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। ভারতে বেতনভোগীরা মাইনের ৩৩ শতাংশই খাওয়া, জামাকাপড় ও সঞ্চয়ের মতো প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির কথা ভাবার আগে EMI দেওয়া নিয়ে ভাবছেন। এই পরিস্থিতি দেশে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেতনভোগীর। ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার সৌরভ মুখোপাধ্যায় রীতিমতো সতর্ক করে বলছেন, 'মানুষ ঋণ নিচ্ছেন কোনও লগ্নির জন্য নয়, জীবনের বেসিক অর্থাত্ প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য। এটাই দুর্ভাগ্যের।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, সহজে ডিজিটাল ঋণ পাওয়া, মজুরি না বাড়া এবং ‘স্টেটাস দেখানো’র প্রবণতা এই ঋণ-সঙ্কটের মূল ইন্ধন। পারফিওস-এর সুজয় ইউ বলেন, 'আজকের ইএমআই-কেন্দ্রিক লাইফস্টাইলে চকচকে গ্যাজেট আর তৎক্ষণাৎ আনন্দ পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু এই আনন্দ ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে, আর এর ফল দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক হতে পারে।'
অর্থনীতিবিদ আরপি গুপ্ত এই পরিস্থিতিকে বলেন, 'একটা টাইম বোমা— যা ভারতের ভোক্তা নির্ভর অর্থনীতিকে ধাক্কা দিতে পারে এবং আয়-বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।' ডেটা সায়েন্টিস্ট মনীশ গোসার এক কথায় বলেন, 'ব্যাঙ্ক আমাদের ফাঁদে ফেলেনি, তারা শুধু দড়ি দিয়েছে, গাঁট আমরা নিজেরাই বেঁধেছি।'
বর্তমানে ভারতের ঘরোয়া ঋণ জিডিপি-র ৪১.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এর বড় অংশই গাড়ি বা বাড়ি কেনার মতো সম্পদ তৈরির জন্য নয়, বরং ক্রেডিট কার্ড, পার্সোনাল লোন বা ‘এখন কিনুন, পরে দিন’ স্কিমে খরচ হচ্ছে— যা সরাসরি ভোগবিলাসের জন্য। একজন ভারতীয়ের গড় ঋণ এখন ৪.৮ লক্ষ টাকা, আর ঘরোয়া সঞ্চয় গত ৪৭ বছরে সবচেয়ে কম। ফলে অনলাইনে যারা নিজেদের দেনা নিয়ে দুঃখ জানাচ্ছেন, তারা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন— এ এক বড় আর্থিক বিপদের পূর্বাভাস।