প্রেমের শহর বলতেই মাথায় আসে প্যারিস। আর প্যারিস বলতেই আইকনিক আইফেল টাওয়ার। আলো ঝলমলে আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে প্রেমিক আংটি পরিয়ে প্রোপোজ করছে, মনে মনে এই দৃশ্য কল্পনা করেনি এমন প্রেমিকার সংখ্যা হাতে গোনা। জীবনে একবার না একবার আইফেল টাওয়ার চাক্ষুস করার স্বপ্ন রয়েছে সকলেরই। কিন্তু সে স্বপ্ন হয়তো অধরাই রয়ে যাবে।
কারণ, ২০২৬ সালে নাকি ভেঙে ফেলা হবে আইফেল টাওয়ার। প্রেমের স্মৃতিবহনকারী বিখ্যাত এই টাওয়ারের চিহ্নটুকুও নাকি আর থাকবে না প্যারিসে। গত কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইফেল টাওয়ারের ছবি সহ এই তথ্যই পোস্ট হচ্ছে। বারবার টাইমলাইনে ঘুরে ফিরে আসছে আইফেল টাওয়ার ভাঙার খবর। সঙ্গে স্যাড ইমোজি। কেসটা কী?
সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, ২০২৬ সালে আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলা হবে। এক্স এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ধরনের পোস্টগুলি। দাবি করা হচ্ছে, এই টাওয়ারটির 'অপারেটিং লিজ' নাকি শীঘ্রই শেষ হচ্ছে। কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও বেড়ে গিয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অত্যধিক। সর্বোপরি জনসাধারণের অভিযোগের কারণে এটি নাকি ধ্বংস করে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এই দাবিগুলোর কোনও ভিত্তি নেই। আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলার এমন কোনও পরিকল্পনা নেই। পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বলে জানিয়েছে প্যারিস প্রশাসন।
আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলার গুজবটির সূত্রপাত একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ থেকে। যা গত ১৮ সেপ্টেম্বর Tapioca Times নামে এক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এই ওয়েবসাইটটি মূলত হাস্যরস ও প্যারোডি বিষয়ক কনটেন্টের জন্য পরিচিত। প্রবন্ধটিতে একটি কাল্পনিক বক্তার বানানো উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, 'আমরা অনেকদিন ধরে ভালই চলছিলাম, এটি দীর্ঘদিন জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু এখন আর কেউ আসে না, তাই আমরা এটি বন্ধ করে দিচ্ছি।' অর্থাৎ পুরো গল্পটিই ছিল মজা করার জন্য তৈরি একটি কল্পিত রচনা, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।
সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধটিতে রসিকতার ছলে বলা হয়েছিল, আইফেল টাওয়ারে পর্যটকের সংখ্যা নাকি কমে গিয়েছে। চারপাশে ড্রোনের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এমনকী কাঠবিড়ালি আর পায়রা নাকি জায়গাটিকে উপদ্রবের স্থানে পরিণত করে ফেলেছে।
এতেই থেমে থাকেনি লেখাটি। সেখানে আরও অদ্ভুত সব বিকল্প ধারণা দেওয়া হয়েছিল। যেমন বিশাল এক ওয়াটার স্লাইড তৈরি করা, লাস ভেগাসের ধাঁচে একটি কনসার্ট হল নির্মাণ করা, কিংবা প্যারিস বার্নিং ম্যান উৎসব আয়োজনের প্রস্তাবও উল্লেখ করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুরো লেখাটি ছিল একেবারেই ব্যঙ্গাত্মক ও কৌতুক বিষয়ক। যার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।
প্রবন্ধটির শেষ রসিকতামূলক অংশে বলা হয়েছিল, আইফেল টাওয়ার ভাঙার কাজ ২০২৬ সালের গোড়াতেই শুরু হবে। এই বাক্যটিই পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে সরাসরি শেয়ার করেন। কিন্তু তারা হয়তো ব্যঙ্গাত্মক প্রসঙ্গটি বুঝতে পারেননি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেছেন। ফলস্বরূপ একটি সম্পূর্ণ মজার ছলে লেখা ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ থেকেই তৈরি হয়ে যায় বিভ্রান্তিকর গুজব।
এই দাবিগুলোর কোনও বিশ্বাসযোগ্য উৎস এখনও পর্যন্ত তা নিশ্চিত করেনি প্রশাসন। আইফেল টাওয়ার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান Société d’Exploitation de la Tour Eiffel (SETE) কোনও বিবৃতি দেয়নি। একইভাবে, প্যারিস সিটি কর্তৃপক্ষ বা ফ্রান্সের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, কেউই এমন কোনও ইঙ্গিত দেয়নি, এই স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে। আসলে আইফেল টাওয়ার এখনও বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত ও যত্নে রক্ষিত সৌধ হিসেবেই পরিচিত।
বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে কারণ আইফেল টাওয়ার বর্তমানে সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। যা শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের ২ অক্টোবর থেকে। তবে এই বন্ধ থাকার বিষয়টির সঙ্গে কোনওভাবেই ভাঙার গুজবের সম্পর্ক নেই। এই সাময়িক বন্ধের কারণ হল,ফ্রান্সজুড়ে সাম্প্রতিক শ্রমিক ইউনিয়নগুলির ধর্মঘট। যেখানে তারা সরকারের ব্যয় কমানোর নীতির প্রতিবাদ করছে এবং ধনীদের উপর অধিক কর আরোপের দাবি জানাচ্ছে।
আইফেল টাওয়ারের সাময়িক বন্ধ থাকা সম্পূর্ণরূপে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব। ভাঙা বা ধ্বংসের কোনও পরিকল্পনার ফল নয়।
এই শ্রমিক আন্দোলন আইফেল টাওয়ারের কর্মী সহ সারা দেশের আরও বহু শ্রমিককে প্রভাবিত করেছে। অতীতেও এমন ধর্মঘটের কারণে স্বল্প সময়ের জন্য টাওয়ার বন্ধ ছিল। এমনটা ঘটেছিল ২০২৩ সালেও। প্রশাসনের সঙ্গে তারা সমঝোতায় এসে পৌঁছলে আইফেল টাওয়ার ফের চালু হবে বলে জানা যাচ্ছে।