১৩ বছর ধরে সে লোহার গরাদে বন্দি রাজা। নাম রাজা। আসলেও সে রাজাই। চলনবলন ঠাটবাটে ও তার গাম্ভীর্য ঈর্ষনীয়। সে এক বেতাজ বাদশাহ।লোহার গরাদের ভেতরেও রাজার রাজকীয়তা এখনও অটুট। তার চোখের এক চাহনিতেই শিরা উপশিরার রক্ত শীতল হয়ে উঠে।পায়ের থাবায় হাড় হিম হয়ে যায়।তার প্রকান্ড গর্জনে কেঁপে উঠে লোহার গরাদ।
আগামী ২৩ শে অগাষ্ট তার পঁচিশতম জন্মদিন। তার জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে এখন থেকেই সাজ সাজ রব। সারা দেশ এমনকি বিশ্বের ইতিহাসেও রাজার জন্মদিন স্মরন করে রাখতে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে।
রাজার জন্মদিন মহা ধুমধাম, আড়ম্বরপূর্ণ করতে চেয়েছিলো জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। তবে বনদপ্তরের সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলেছে করোনা মহামারী।
যদিও রাজার জন্মদিন বলে কথা। আর রাজার জন্মদিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তামাম বিশ্ব। তাই রাজার জন্মদিন হচ্ছে। তবে ভার্চুয়ালি। সবুজ রংয়ের প্রলেপ দিয়ে রাঙ্গিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজার গরাদ।
বেলুন, কেক ও মোমবাতি দিয়ে সাজানো হবে রাজার কুঠুরি। ওই দিন বাঘ সংরক্ষণের উপর সারা দেশ ব্যাপী একটি অনলাইন ক্যুইজ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করবে বনদপ্তর। সেই দিনই রাজার ১৩ বছরের বন্দিজীবনের নানা মুহুর্তের ভিডিও অনলাইনে দেখাবে জলদাপাড়া বনদপ্তর।
জেনে নেওয়া যাক "রাজার" আসল পরিচয়। রাজা সুন্দরবনের এক জঙ্গলি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে তরতাজা টগবগে ফুটন্ত রক্তের রাজার দাদাগিরিতে ভয়ে থরহরি কাঁপতো গোটা সুন্দরবন।
বনদপ্তর জানিয়েছে, ২০০৮ সালে সুন্দরবনের মাতলা নদী সাঁতরে পার করার সময় রাজার পেছন দিকের ডান পায়ের প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে নেয় কুমির। তারপর প্রায় মৃত্যুর মুখে চলে যাওয়া রাজাকে নিয়ে আসা হয় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ খয়েরবাড়ির বাঘ পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
সেখামেই সে ধিরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে পঙ্গু রাজাকে আর জঙ্গলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেটিভ অথরিটি।
বেশ কয়েক বছর আগে রাজার সঙ্গী ছিল বিভিন্ন সার্কাস থেকে উদ্ধার হওয়া আরও ১৯ রয়াল বেঙ্গল টাইগার। তবে বয়সের ভারে বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত হয়ে একে একে সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
তবে ২৫ বছরের রাজা জীবনের প্রায় সায়াহ্নে এসেও এখনও তার রাজকীয়তায় অটুট। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের ডিএফও জানাচ্ছেন, জঙ্গলের পরিবেশে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বড়জোর ১৮ বছর বাঁচতে পারে। আর ঘেরাটোপে ২০ বছর।
তবে বনদপ্তরের সব হিসেব নিকেশ ভুল প্রমানিত করে জীবনের কোয়ার্টার সেঞ্চুরি পার করার পথে বেতাজ বাদশাহ "রাজা"। ডিএফও দীপক এম জানান, "সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ছাড়া বাকি ছয়দিন রাজার বরাদ্দ হাড় ছাড়ানো আট কিলো গোমাংস।
সঙ্গে দেওয়া হয় গ্লুকোজ, ওআরএস সহ প্রয়োজনীয় ওষুধ। শীতকালে রাজার কুঠুরিতে রয়েছে রুম হিটারের ব্যবস্থা। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান সূত্রের খবর বিশ্বের ইতিহাসে রাজাই একমাত্র রয়াল বেঙ্গল টাইগার যে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ২৫ বছরে পা রাখতে চলেছে।
রাজার হলুদ চোখের অপলক দৃষ্টিতে আজও জঙ্গলের শিকার ধরার সেই নৈপুণ্য স্পষ্ট। তাই "রাজার" জীবন বাঁচাতে রাজাকে বন থেকে তুলে নিয়ে আসা হলেও রাজার মনের থেকে জঙ্গলকে সরানো যায়নি।