চৈত্রের চড়া রোদ। কিন্তু, চড়ক পুজোর মাস যে। তাই রাস্তায় দেখা যাচ্ছে শিবভক্তদের। কারও পরনে লাল শালু, কেউ আবার শিবের সাজে দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করছে। বাড়ি থেকে তারা সংগ্রহ করছে চাল, ডাল, আলু, ফল, মধু ইত্যাদি। এটাই রীতি। এই ভিক্ষার সামগ্রী দিয়েই নিজেদের উপোসভঙ্গ করেন ভক্তরা।
এই চরকতলা ছাড়িয়ে গেলেই কুমারগ্রাম যাওয়ার রাস্তা। কুমারগ্রাম আলিপুরদুয়ার জেলার একটি বিধানসভা কেন্দ্র। আলিপুরদুয়ারের দুয়ার শব্দের একটি আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। তা হল, ভুটানে যাওয়ার দ্বার। আপাতদৃষ্টিতে এই এলাকাকে শান্তিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। যেন উত্তরবঙ্গ ও আসামের অন্যতম ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের রক্তাক্ত ইতিহাসকে বিশ্বাস করে না এই জায়গা। অথচ এই কুমারগ্রামের উত্তর হলদিবাড়ি গ্রামে জীবন সিংহের পৈতৃক বাড়ি । যার নাম ছিল উত্তরবঙ্গের ত্রাস। জীবন সিংয়ের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা কামতাপুরি লিবারেশন অর্গানাইজেশন সম্পর্কে একটু জেনে নেব।
কামতাপুরি লিবারেশন অর্গানাইজেশন কী?
কামতাপুরি হল একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। যারা
উত্তরবঙ্গ তথা অসমের বেশ কয়েকটি জেলাকে এক করে পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবি জানিয়েছিল। তারা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা ও অসমের গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি, বঙ্গাইগাঁও, কোকড়াঝাড়, বিহারের কিষাণগঞ্জ ও নেপালের ঝাঁপা জেলা নিয়ে রাজ্য গড়ার আন্দোলন শুরু করে।
কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে একসময় কোচবিহার থেকে মালদহ পর্যন্ত ৬ জেলায় সংগঠন বাড়িয়েছিল কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন৷ তারা অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় তোলাবাজি, ডাকাতি, লুঠ ছাড়াও অসংখ্য নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছিল৷ শোনা যায়, জলপাইগুড়ি সংলগ্ন ভুটানের জঙ্গলেও ঘাঁটি করে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল প্রচুর রাজবংশী যুবক-যুবতি। তবে নয়ের দশকের পর এই আন্দোলন থিতিয়ে যায়।
জীবন সিং কে?
তামির দাস। জন্মসূত্রে এই নামই ছিল জীবন সিংয়ের। কামতাপুরি লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান তিনি। শিলিগুড়িতে পড়াশোনা করার সময় কামতাপুরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রধান মুখ হিসেবে উঠে আসেন। তাঁর স্ত্রী ভারতী দাস সংগঠনের মহিলা গ্রুপের প্রধান ছিলেন। ১৯৯৯ সালে অসম পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন জীবন। ছাড়াও পান। তারপর ফের সংগঠনের হাল ধরেন।
কুমারগ্রামের উত্তর হলদিবাড়ি গ্রামে গেলে আজও শোনা যায় তামিরের কথা। গ্রামবাসীরা তাঁকে এই নামেই মনে রেখেছে। তামিরের বড় ভাই সমীর এখনও সেই গ্রামেই পৈতৃক ভিটেতে থাকেন। তিনি যে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার দাদা, তা দেখে বোঝার উপায় নেই। খুব সাধারণ জীবন-যাপন করেন। আচরণেও বিনয়ী।
সমীর জানান, একসময় মাঝে মাঝেই তামিরকে ধরতে এই বাড়িতে হানা দিত পুলিশ। অত্যাচার করত। তবে এখন আর আসে না।
পুলিশের তরফেই দাস পরিবারকে জানানো হয়েছিল, জীবনের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর। পাকস্থলীর অসুখজনিত কারণে মারা যান তিনি, পুলিশ নাকি এমনটাই জানিয়েছিল। সমীর বলেন, 'তামির যে বিয়ে করেছে এই কথাও আমরা জানতাম না। ওর সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল সেই ৩০ বছর আগে। যখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত।'
KLO নেতার গড়ে BJP-র থাবা
এখন পশ্চিমবঙ্গে ভোট চলছে। কোন দলকে সমর্থন করছে জীবন সিংয়ের গ্রাম? তাঁর ভাই জানালেন, তাঁরা BJP-কে সমর্থন করছেন। তাঁদের চেনা ছেলে প্রার্থী হয়েছে। এই গ্রামে এখনও কামতাপুরি আন্দোলনের জন্য আবেগ রয়েছে। তাহলে কীভাবে BJP সংগঠন গড়ে তুলতে পারল?
প্রশ্নের উত্তরে সমীরবাবু জানালেন, তৃণমূলের প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ। তিনি নিজে জীবনের দাদা হওয়ায় কোনওরকম সাহায্য পাননি। কিন্তু, যে জীবনের জন্য এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে সেই তিনি কোথায়? সমীরবাবু বলে চললেন, 'তা তো জানি না। কেউ বলে ও মরে গিয়েছে। কারও মতে বেঁচে আছে। কিছুদিন শুনেছি ভুটানে ছিল। ও নাকি মায়ানমারে ভালোই আছে।'
সমীর দাসের মতো যাঁদের বয়স তাঁরা জীবন সিংকে মনে রেখেছে। তবে সেই আন্দোলন নিয়ে ততটা ওয়াকিবহাল নয় এF প্রজন্ম। যেমন, সমীর দাসের ছেলে অভিষেক। ২২ বছরের এই যুবক জানালেন, তাঁরা বিজেপিকেই ভোট দেবেন। গেরুয়া শিবিরের হয়েই কাজ করবেন।