রাজ্যের একপ্রান্তে যখন মণ্ডপ ছাড়ছেন উমা, বিসর্জনের শঙ্খধ্বনিতে বুক ভরে আসছে মনখারাপের দীর্ঘশ্বাসে, তখন উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ গ্রামে উৎসব যেন সবে শুরু। দশমী পেরোতেই সেখানে শুরু ভাণ্ডানি পুজো। একাদশী থেকে লক্ষ্মীপুজো। চার দিন ধরে চলে দেবী বন্দনা। সন্ধ্যার পর বসে মেলা। আলোয় ঝলমলে গ্রাম-গঞ্জ, রাতভর ঢাক-উলু আর পুজোর সাজে মাতোয়ারা লোকজন।
ভাণ্ডানি, উত্তরবঙ্গের ঘরের মেয়ের মতো। দেবী দুর্গারই এক ‘স্থানীয়’ রূপ। মহিষাসুরমর্দিনী নন তিনি। দুই হাতের এক সরল গ্রামীণ নারী, যিনি বাঘের পিঠে চড়ে আসেন। সিংহ নয়, কারণ এই অঞ্চলের অরণ্যে একসময় ঘুরে বেড়াত রাজা বাঘ, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। দেবীর সঙ্গেই থাকেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ। শুধু অনুপস্থিত অসুর। কারণ এই পুজোয় নেই যুদ্ধের কাহিনি, আছে কৃতজ্ঞতার গল্প।
কোথায় এই পুজোর চল?
ভাণ্ডানি পুজো মূলত দেখা যায় জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজার ও আলিপুরদুয়ারের কিছু অংশে। পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলার কিছু গ্রামেও রয়েছে এই উৎসবের চল। স্থানীয় রাজবংশি কৃষক পরিবার থেকেই শুরু হয়েছিল এই পুজো। এখন অবশ্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেকেই যোগ দেন ভাণ্ডানির আরাধনায়।
একাদশীতে দেবী ফিরলেন
স্থানীয়দের বিশ্বাস, বিসর্জনের রাতে কৈলাস ফেরার পথে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন উমা। গভীর জঙ্গলের মধ্য থেকে তাঁর কান্না শুনে ছুটে আসেন বনবস্তির মানুষ। তাঁরা সেই গ্রামীণ বধূর মতো দেখতে দেবীকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। দেবী পরিচয় জানান সকালে, বলেন‘‘তোমাদের আতিথ্যে আমি তুষ্ট।’’ আশীর্বাদ দেন, গ্রামের ভাণ্ডার সারা বছর ভরা থাকবে। সেই থেকেই ‘ভাণ্ডানি’র আরাধনা।
রাজাদের অনুমতি লাগত
ঐতিহাসিক সূত্র বলছে, সেই সময় দুর্গাপুজো আয়োজন করতে হলে রাজাদের অনুমতি লাগত। ফলে স্থানীয়রা নিজেদের ইচ্ছেমতো পুজোর আয়োজন করতে গিয়ে শুরু করেন ভাণ্ডানি পুজো, এক ধরনের বিকল্প দুর্গা, কিন্তু পুরোটাই স্থানীয় আবেগে গড়া। দেবীর আরাধনা চলে তন্ত্র মতে। পুজোর পাশাপাশি বসে মেলা, হয় যাত্রা, গান, নাটক। পাঁচ শতাব্দী পেরিয়েও টিকে থাকা এই উৎসব আজও বহন করে উত্তরবঙ্গের নিজস্ব গর্ব, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য।