গত কয়েকদিন হল খবরের শিরোনামে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। সংবাদমাধ্যমকে বেনজির ভাবে আক্রমণ করে দু'পয়সার প্রেস বলে মন্তব্য করে অসৌজন্য দেখানোর পরও নিজের অবস্থান থেকে সরেননি এই সাংসদ। দলও যে মহুয়ার মন্তব্যকে সমর্থ করে না, তা বুঝিয়ে দেওয়ার পর সরাসরি দুঃখপ্রকাশ না করে তির্যক মন্তব্য জারি রেখেছেন মহুয়া। তবে মানুষকে হেয় করা যেন কর্পোরেট জগত থেকে রাজনীতিতে আসা মহুয়ার স্বভাবেই রয়েছে। এর আগেও বহুবার নিজের মন্তব্য ও কার্যকলাপের জন্য বিতর্কে জড়িয়েছেন নদিয়ার জেলার তৃণমূল সভানেত্রী ।
মহুয়া মৈত্রের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। চলতি বছরের অগস্টের এক রবিবার ৭ নম্বর লোককল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জাতীয় পাখি ময়ূরদের নিজের হাতে খাওয়ানোর এবং ময়ূরদের সঙ্গে সময় কাটানোর ভিডিয়ো প্রকাশ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র সেইসময় প্রধানমন্ত্রীর সেই ময়ূর-সঙ্গ নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। ট্যুইটারে বহু পুরনো এক সংবাদপত্র জার্মানির শাসক হিটলারের হরিণ খাওয়ানোর একটি দৃশ্যের ছবি শেয়ার করে মোদীর ময়ূর-সঙ্গকে বিদ্ধ করেছিলেন মহুয়া।
মহুয়া হিটলারের ছবি শেয়ার করে লিখেছিলেন, 'ছোট্ট হরিণদের খাওয়াচ্ছেন হিটলার। এতেই বোঝা যাচ্ছে প্রকৃতির সংস্পর্শে এলে মানুষের আসল ছবিটা সামনে চলে আসে।' কটাক্ষের সুরেই বাক্যবন্ধ ব্যবহারের করেছিলেন মহুয়া। গত বাদল অধিবেশনে পিএম কেয়ার্স ফান্ড নিয়ে মোদী-শাহ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাোনর সময় ‘উলঙ্গ রাজা’ প্রসঙ্গ টেনে মোদী সরকারকে তুলোধোনা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে তোপ দেগেই মহুয়া সেবার বলেন, “আজকের ভারত আমাকে সম্রাটের নতুন পোশাকের জন্য হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে সম্রাটের পরনে কিছুই ছিল না। তবে স্তাবক দরবারীরা সেটি রাজাকে বলতে পারেনি।” এরপরই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা ‘উলঙ্গ রাজা’র প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন, “বাংলার কবি তার কবিতায় বলেছিলেন পুরো রাজ্যের একমাত্র ছোট নিষ্পাপ বালক উঠে দাঁড়িয়ে একবার নগ্ন সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করার সাহস দেখিয়েছিল। বলেছিল, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’ আর আজ আমি একই প্রশ্নটি করছি: সম্রাট, আপনার কাপড়গুলি কোথায়?”
মহুয়ার শ্লেষ থেকে রক্ষা পাননি রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও। শাসক দলের সঙ্গে রাজ্যপালের যে মাঝেমধ্যেই বাগযুদ্ধ চলে তা সকলেরি জানা। সেই ট্যুইট যুদ্ধেই জগদীপ ধনখড়কে ‘আঙ্কলজি’তিরে বিঁধতে দেখা গেছে মহুয়াকে।
করোনা কালে গড়িয়া শ্মশানে বেওয়ারিশ লাশ দাহ করা নিয়ে রাজ্য সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করছিলেন রাজ্যপাল। ফলে সই সময় ট্যুইটেই তাঁর মোকাবিলায় নেমেছিলেন মহুয়া। ‘আঙ্কলজি’ সম্বোধনের পাশাপাশি ‘পচা আপেল’ বিশেষণও দিয়েছিলেন রাজ্যপালকে। মহুয়া রাজভবনের উদ্দেশে কামান দেগে সেবার ট্যুইট করেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল আবার বিজেপির হয়ে রাজ্য সরকারের দিকে তির ছুড়তে নেমেছেন। রাজ্য সরকার একই সঙ্গে কোভিড, আমফান সামলে শ্রমিকদের ফেরানোর কাজ চালাচ্ছে মসৃণভাবে। পচা আপেল গাছ থেকে খুব বেশি দূরে পড়ে না।’ আরেকটি ট্যুইটে মহুয়া লেখেন, ‘‘আঙ্কলজি এ বার দাবি করছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনের উপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, এটা এমন বিষয়, যা আপনার গুজরাতের বসরা অন্য যে কারোর চেয়ে অনেক ভাল করতে পারেন। আমরা সবাই এ ব্যাপারে শিক্ষানবীশ।’’ মহুয়ার কটাক্ষ যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে উদ্দেশ্য করে, তা বলাইবাহুল্য।
গতবছর সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণেই সবার নজর কেড়েছিলেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। অনেকেই তাঁর বক্তব্যে পেয়েছিলেন ঝাঁঝ। তুখোড় ইংরাজি আর স্পষ্ট উচ্চারণে কিছুক্ষণের জন্য যেন গোটা লোকসভা স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন তৃণমূলের ইয়ং ব্রিগেডের এই সদস্য। কিন্তু দিন কয়েক কাটতে না-কাটতেই তাঁর ভাষণ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। অভিযোগ, একটি মার্কিন প্রকাশনা থেকে বেমালুম ভাষণ টুকেছেন মহুয়া মৈত্র।
মোদী সরকার কীভাবে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে, সেকথাই বিস্তারিত ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন মহুয়া তাঁর ভাষণে। ফ্যাসিবাদের সাতটি চিহ্নই মোদি সরকারের ভারতে প্রকট, দাবি করেছিলেন তিনি। ২৫ জুনের সেই ভাষণের ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অভিযোগ ওঠে ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি ওয়াশিংটন মান্থলি নামে এক পত্রিকায় প্রকাশিত 'ওয়ার্নিং সাইনস অফ ফ্যাসিজম' শীর্ষক প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি পংতি হুবহু তাঁর ভাষণে ব্যবহার করেছেন মহুয়া। কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননি। যদিও সেই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন মহুয়া স্বয়ং৷
যদিও ওয়াশিংটন মান্থলির তরফে ট্যুইট করে দাবি করা হয়, “ফ্যাসিবাদের ১২টি লক্ষণ” শীর্ষক প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে, সেখান থেকেই বক্তব্যের অংশ তুলে ধরেছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র।
৪৫ বছর বয়সী এই প্রাক্তন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের ওপরই নদিয়ায় বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে ভরসা রেখেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। যদিও তৃণমূল নয়, ২০০৮ সালে জেপি মরগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান কংগ্রেসের হাত ধরে।
১৯৭৫ সালের ৫ মে কলকাতার অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্ম মহুয়া মৈত্রের। স্কুল জীবন তিলোত্তমাতে কাটিয়েই এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। ম্যাসাচুসেটসের মাউন্ট হলইয়োক কলেজ থেকে গণিত ও অর্থনীতির উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি করেন। এরপর তিনি যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক জেপি মরগানে। প্রথমে তিনি নিউ ইয়র্কে কর্মরত ছিলেন। এরপর তাকে লন্ডনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লন্ডনে তিনি জেপি মরগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেপি মরগানের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানিতে সফল ক্যারিয়ার গড়লেও কলেজ জীবন থেকেই মহুয়ার রাজনীতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল।
শোনা যায় মাউন্ট হলইয়োকের রিইউনিয়ন মহুয়া মৈত্রের জীবন বদলে দিয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর তিনি দেখেন যে তার প্রায় সব বন্ধুই সফল ব্যাঙ্কার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সবার ভীড়ে তাই নিজেকে বিশেষ একজন হিসেবে উপস্থাপন করতে পারিছেলন না মহুয়া। তই নিজেকে আলাদা করার তাগিদেই ২০০৮ সালে জেপি মরগানের চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরেন মহুয়া মৈত্র। রাজনীতি ও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং আপাতদৃষ্টিতে দুটি ভিন্ন বিষয় মনে হলেও মহুয়া দুটি বিষয়ের মধ্যে বিস্তর মিল খুঁজে পান।
দেশে ফেরার পর মহুয়া প্রথমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুব সংগঠন ভারতীয় যুব কংগ্রেসে যোগ দেন। রাহুল গান্ধীর বিশ্বস্ত যোদ্ধা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতও করেন। সেই সময় কংগ্রেস সভাপতি রাহুলের চালু করা 'আম আদমি কা সিপাহি' প্রজেক্টে মহুয়া মৈত্র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার নিজ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের শক্তি বলতে শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদ। কিন্তু সেখানেও তৃণমূল আধিপত্য বিস্তার করার কারণে কংগ্রেসের হয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে নিজেকে বেশিদূর নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব না তা বুঝে গিয়েছিলেন মহুয়া। আর সেই কারণে ২০১০ সালে কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে তিনি দলীয় প্রধান মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের আস্থা অর্জন করেন। দ্রুত দলে তার উত্থানও ঘটে। মমতা ব্ তাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের আসনে বসান। এবং দলের জাতীয় মুখপাত্র হিসেবেও নিয়োগ করেন। দলের মুখপাত্র হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন টক শোতে মহুয়া ছিলেন পরিচিত মুখ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন আসে। কর্পোরেট ব্যাকগ্রাউন্ড এবং তার পশ্চিমি লাইফস্টাইল থেকে এসেও নদিয়ার করিমপুর আসন থেকে জয়লাভ করে বিধায়ক হন মহুয়া। এরপর ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সাংসদ। কর্পোরেট জগতের মত রাজনীতিতেও মহুয়ার সাফল্য চোখ ধাঁধানো। তবে ব্যক্তি মানুষকে ও পেশাকে সম্মান দেখানোর বিষয়ে হয়তো এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে তৃণমূলের এই হাইপ্রফাইল নেত্রীকে।