
বিভিন্ন মনীষীদের নামে রেলস্টেশনের নাম হতে আমরা আকছার দেখছি। কেবল রেলস্টেশন কেন বিমানবন্দু, রাস্তা, স্টেডিয়াম সবকিছুই মনীষীদের নামে নামাঙ্কিত করা হয়ে থাকে। তবে জানেন কি প্রথম কনোও মহিলার নামে রেলস্টেশনের নাম হয়েছিল আমাদের বাংলাতেই। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বেলানগর। আর এই স্টেশনের নাম হয়েছিল এক মহীয়সী নারীর নামে। যিনি আর কেউ নন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইঝি। এছাড়াও বর্তমান প্রজন্ম আরও একটি পরিচয়ে চিনবেন তাঁকে। বর্তমানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মা হলেন বেলা মিত্র। দেশের অগ্নিযুগের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী আজ আমাদের স্মৃতির অতলে চলে গিয়েছেন। বেলানগর স্টেশন থাকলেও সদ্য জন্মশতবর্ষ পার করা বেলা মিত্রের কথা আজ মনে আছে কজনের? চলুন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই স্মৃতিকে আরও একবার উস্কে তোলা যাক।
আজাদ হিন্দের নারী সৈনিক বেলা মিত্র
সম্পর্কে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইঝি। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে, মাতুলালয়ে, ভাগলপুরে। নেতাজির দাদা সুরেশচন্দ্র বসুর ছোট মেয়ে বেলা বসুর পিত্রালয় ছিল ২৪ পরগনার কোদালিয়ায়। ১৯৩৬-এ বিবাহ যশোরের হরিদাস মিত্রের সঙ্গে। বেলাদেবী ১৯৩৮-এ শ্বশুরবাড়িতে গড়ে তোলেন এক মহিলা সমিতি। ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন থেকে বেরিয়ে এসে নেতাজি যখন আপস-বিরোধী সম্মেলনের ডাক দেন, বেলা তখন মাত্র ১৯ বছরের যুবতী। সেই সম্মেলনের মহিলা শাখার কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় তদদিনে বসু থেকে মিত্র হয়ে ওঠা বেলাদেবীকে। ১৯৪৪-এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেহালার এক ভাড়াবাড়ি থেকে ট্রান্সমিটার মারফত সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুনে নেতাজির সঙ্গে সংবাদ-বিনিময়ের ব্যবস্থা করেছিলেন মিত্র দম্পতি। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেতাজির পাঠানো আজাদ হিন্দ ফৌজের লোকজনদের ওড়িশার কোনারক মন্দিরের কাছে নিরাপদে অবতরণের ব্যাপারে জীবন বিপন্ন করে প্রভূত সহায়তা করেছিলেন বেলা ও হিরদাস মিত্র। বেলা দেবীকে এ জন্য নিজের সব গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল।
পরীক্ষা নিয়েছিলেন গান্ধীজি
১৯৪৪ এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কলকাতার এক গোপন স্থান থেকে সিঙ্গাপুরে ট্রান্সমিটারে সংবাদ আদানপ্রদান ও নিরাপদে বিপ্লবীদের কাছে সেই বার্তা পেঁছে দিতেন হরিদাস ও বেলা মিত্র। হরিদাস মিত্র গ্রেফতার হলে বেলা একাই সেই কাজের দায়িত্ব নেন। ১৯৪৫-এ হরিদাস মিত্র সমেত ২১ জন বন্দির ফাঁসির আদেশ হয়। যাঁদের মধ্যে ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের এক শীর্ষ নেতা সহ চারজন। হরিদাস মিত্র ছাড়া বিপ্লবী দলে ছিলেন পবিত্র রায, জ্যোতিষচন্দ্র বসু ও অমর সিং গিল। চারজন একসঙ্গেই ধরা পড়েছিলেন। এই অবস্থায় বেলা দেবী পুণাতে গিয়ে গান্ধীজির শরণাপন্ন হন এই আদেশ রদ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার আর্জি নিয়ে। বেলাকে পরীক্ষা করার জন্য গান্ধীজি নাকি বলেছিলেন, শুধু হরিদাস মিত্রের জন্য তিনি চেষ্টা করতে পারেন। কেবলমাত্র স্বামীকে বাঁচানোর স্বার্থপর প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন বেলা দেবী। স্পষ্ট বলেন, "না। করলে সবার জন্য, না হলে নয়।" খুশি হন গান্ধীজি। অতঃপর ইংরেজ সরকারের সঙ্গে প্রবল পত্রযুদ্ধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সকলের ফাঁসির সাজা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বদলে দিতে সক্ষম হন।
চারিত্রিক দৃঢ়তা
১৯৪৫ -এ বাপুজির মুখের উপর এমন কথা সরাসরি বলার জন্য আলাদা চারিত্রিক দৃঢ়তা লাগতো। লাগতো সাহস এবং কঠোর সত্যনিষ্ঠা । সেই দৃঢ়তা ছিল বেলা মিত্রের। পারিবারিক সূত্রেই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি টান জন্মেছিল। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে বেলা দেবী নেতাজির ঝাঁসি রেজিমেন্টের আদর্শে গঠন করেন ঝাঁসি রানি বাহিনী, সর্বাধিনায়িকা ছিলেন নিজেই। বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানেও গড়ে ওঠে এর শাখা। স্বাধীনতা লাভের পর শিয়ালদা স্টেশনে এবং অন্য কয়েকটি স্থানে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন বেলাদেবী। এ ছাড়া বেশ কিছু শরণার্থী পরিবারের বালি ও ডানকুনির মধ্যবর্তী অভয়নগর অঞ্চলে পুনর্বাসনের ব্যাপারে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। এ সব কাজের দ্রুত ভেঙে যেতে থাকে শরীর। ১৯৫২-র ৩১ জুলাই মাত্র ৩২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় এই মহীয়সী নারীর।
পর্দার আড়ালেই থেকেছেন
বেলা মিত্র পর্দার আড়ালে থেকেই কাজ করে গেছেন আজীবন। বেলা মিত্রকে সম্মান জানাতে ভারতীয় রেল হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনে তাঁর স্থাপিত অভয়নগর উদ্বাস্তু কলোনির কাছেই একটি রেল স্টেশন স্থাপন করে। স্টেশনটির নাম রাখা হয় 'বেলানগর'। ১৯৫৮ সালের ২৩ নভেম্বর এই স্টেশনটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতীয় রেলের উপমন্ত্রী তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে বেলার সহযোদ্ধা শাহনওয়াজ খান। ভারতের রেলের ইতিহাসে বেলানগরই প্রথম রেল স্টেশন , যার নামকরণ হয়েছিল কোনও মহিলার নামে।
জন্মশতবর্ষে স্মৃতির অতলে
গত বছরই পালিত হয়েছে বেলাদেবীর জন্মশতবর্ষ। কিন্তু দেশের এই মহীয়সী নারীকে আমরা কেউ মনে রাখিনি। জানা যায় হরিদাসবাবু আন্দামান থেকে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি একসময় বাংলার ডেপুটি স্পিকারও হয়েছিলেন। বেলা মিত্রের পুত্র অমিত মিত্র, প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থমন্ত্রী। বেলা তাঁর জীবন, কর্ম ও আত্মোৎসর্গে যে প্রেরণার সঞ্চার করেছিলেন তা যেন হারিয়ে না যায়, বরং অনুরণন যেন ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বীরাঙ্গনা বিপ্লবী, সমাজসেবীকে আমার ভুলতে বসেছি। এবার যখন ট্রেনে করে বেলানগর স্টেশনের ওপর দিয়ে যাবেন, আশা করি সেই মহীয়সী নারীর কথা নিশ্চয় মনে পড়বে।