লক ডাউনের বিড়ম্বনা
লকডাউন এর বিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত জনজীবন। গত এক বছর থেকে বারবার ছন্দপতন ঘটিয়েছে করোনার এই সাইড এফেক্ট। তছনছ হয়ে গিয়েছে পুরো সামাজিক প্রক্রিয়া। ঘেঁটে গিয়েছে পূর্বনির্ধারিত বহু কর্মকাণ্ড। বাদ যায়নি তরাই-ডুয়ার্স-পাহাড়ের অন্যতম অর্থনৈতিক লাভজনক ফিল্ম ট্যুরিজমও।
কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি
বাতিল করতে হয়েছে বহু চলচ্চিত্রের শুটিং। টলিউড-বলিউড থেকে দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। সব মিলিয়ে লম্বা তালিকা। সব মিলিয়ে ইতিমধ্যেই অন্তত কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। লকডাউন কতদিন চলবে, তার ওপর নির্ভর করে অন্তত কয়েকশো কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
বাতিলের তালিকায় কারা
করণ জোহরের ধর্মা প্রোডাকশন, রাজশ্রী প্রোডাকশনের মতো বলিউড প্রযোজনা সংস্থাগুলি থেকে টলিপাড়ার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল বা দক্ষিণের পরিচালক মনিরত্নম, বাতিলের তালিকায় কারা নেই! সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে এই সময়ের মধ্যে কিংবা গত এক বছরে উল্লিখিত ছবিগুলির শুটিং শেষ হয়ে যেত। পাহাড় কিংবা ডুয়ার্সের মোহময়ী লোকেশনে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যেত এই সমস্ত প্রযোজনা সংস্থার শুটিং ইউনিটগুলিকে।
বদলোনো সূচি আর ফেরেনি
গত এক বছরে শুটিং চলার কথা ছিল একাধিক চলচ্চিত্রের। একের পর শুটিং বাতিল হয়েছে। কখনও আগাম বাতিল করা হয়েছে। কখনও আবার শুটিংয়ে এসেও ফিরতে হয়েছে। গত বছর সিনেমার শুটিংয়ের জন্য লামাহাটা পৌঁছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়দের। তড়িঘড়ি তাঁদের জরুরি গাড়িতে কলকাতা ফেরত পাঠানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ওই শুটিং ইউনিটের দায়িত্বে থাকা বাবলু বন্দোপাধ্যায়। তাঁরা পরে শুটিং শিডিউল বদলে নিয়েছেন।
শুটিং বাতিলের মেলা
গত এক বছরে একের পর এক ছবির শুট বাতিল করতে হয়েছে। তার মধ্যে একটি বলিউডের ছবির শুটিং করতে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত দার্জিলিং, কালিম্পং ছিলেন অভিনেত্রী তাপসী পান্নু। মাঝে মুম্বই ফিরে গেলেও ফের এপ্রিলে শুটিংয়ে আসার কথা ছিল তাঁর। পরে সেটিরও শুটিং শিডিউল বদলে যায়। করণ জোহরের ধর্মা প্রোডাকশন একটি নতুন ছবি শুটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল এপ্রিলের শেষ থেকে। প্রায় গোটা মে মাস ধরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় শুটিং চলার কথা ছিল। চল্লিশ দিনের একটি শুটিংয়ের সমস্ত পরিকল্পনা ও অগ্রিম বুকিং হয়ে গিয়েছিল। হোটেল-রিসর্ট-সহ অন্যান্য বুকিং আপাতত বাতিল। আপাতত সে সব মুলতুবি রাখতে হয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। জি বাংলা চ্যানেলের নিজস্ব প্রযোজনা ‘তিতলি’ নামে একটি মেগা ধারাবাহিকের ১৫ দিনের শুটিং হওয়ার কথা ছিল এপ্রিলের শেষে। সে সব এখন অলীক স্বপ্ন। পাশাপাশি ডুয়ার্স এবং পাহাড়ে শুটিং আসার কথা ছিল এম রবি, অর্জুন সারিয়া-সহ আরও কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর। সেগুলোও বাতিল হয়েছে।
বুনো বসন্তই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের উত্তরবঙ্গের অন্যতম ব্যবস্থাপক দীপজ্যোতি চক্রবর্তী জানান, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে এক-দেড়শো কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে শুটিংয়ের চাহিদা আগেও ছিল। ইদানীং তা আরও বেড়েছে। সারা বছরই টানা শুটিং থাকে উত্তরবঙ্গ তথা ডুয়ার্স, তরাই, পাহাড়ে। বিশেষ করে এই সময় বসন্তে যখন পাহাড়-ডুয়ার্সে রকমারি ফুলের সমাহার ঘটে, প্রকৃতির এই দৃশ্য তুলে ধরতে এর আগে বারবার ছুটে এসেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, অনুরাগ বাসু থেকে শুরু করে শক্তি সামন্ত কিংবা রাজ চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে।
অর্থনীতিতে ধাক্কা
তাই লকডাউনের প্রভাবে এতগুলো শুটিং বাতিল হয়ে গেলে অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে বলে মনে করছে চেম্বার অব কমার্সও। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সংগঠনগুলির মতে, চলচ্চিত্র পর্যটন এলাকার অন্যতম অর্থনৈতিক ভিত্তি। বিশেষ করে যে কোনও শুটিং ইউনিটের সঙ্গে ৫০ থেকে ১০০ বা কখনও তারও বেশি লোক এসে থাকেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে থাকা, যাতায়াত, সমস্ত মিলিয়ে একটা বড় অংশের কর্মসংস্থান হয়। সে সমস্ত কিছু বন্ধ থাকায় গোটা সার্কিটটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। যার আর্থিক ক্ষতি কোটি টাকার কম নয়। আর যে সময় নষ্ট হচ্ছে, তার জন্য যে ক্ষতি তা তো আর টাকার অঙ্কে হিসেব করা সম্ভব নয়।
তবু আশার আলো
তবু তার মধ্যেও কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে, শুটিং ইউনিটগুলির নাছোড় মনোভাবে। এই মুহূর্তে বালাজি টেলিফিল্মসের পক্ষ থেকে একটি শুটিংয়ের রেইকি চলছে ডুয়ার্সে। টিভি সিরিয়ালের নাম ভাগ্যলক্ষ্মী। অন্যদিকে একটি মেগা বাজেটের বলিউড ফিল্মের রেইকি হয়ে গিয়েছে। সেটিও ১৫ জুনের পর পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে শিডিউল তৈরি করা হচ্ছে।