গত রবিবার থেকে কেবল রাজ্য রাজনীতিই নয় রাজধানী দিল্লিতেও জোর আলোচনা চলছে বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে নিয়ে। যার মূলে রয়েছে একটি জল্পনা। সংসদে বাদল অধিবেশন শুরু হতে আর দুই সপ্তাহ বাকি নেই। তার আগেই নাকি লোকসভার দলনেতার পদ থেকে অধীরকে অপসারিত করতে চাইছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। একাধিক সংবাদপত্রে এই নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়। কাটাছেড়া শুরু হয়ে যায়, কেন অধীরের ওপর কোপ পড়তে চলেছে। তাতে সম্ভাব্য কারণ হিসাবে উঠে আসছে অধীরের অতিরিক্ত তৃণমূল বিরোধিতা। এদিকে একুশের ভোটে রাজ্যে একটিও আসন না পাওয়া কংগ্রেস ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে চাইছে। আর সেই কারণেই লোকসভায় খারাপ পারফরম্যান্স না করলেও পদ হারাতে পারেন বহরমপুরের সাংসদ। এমনটাই শোনা যাচ্ছে। নিজের অপসারণ নিয়ে চলতে থাকা জল্পনা পৌঁছেছে প্রদেশ সভাপতির কানেও। আর এর মাঝেই যেন তাল কেটেছে বহরমপুরের সাংসদের চেনা ছন্দে।
অতীতে বরাবরই অধীরের গলায় মমতা বিরোধিতার সুর শোনা গিয়েছে। মমতাকে কটাক্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করতে দেখা গেছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে। এবারের বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নামতে দেখা গিয়েছিল অধীরকে। তার ফল খুব একটা সুখকর হয়নি। ২০১৬ সালের বিধানসভাতে প্রধান বিরোধী দলের সম্মান পাওয়া কংগ্রেস এবার একটিও আসন পায়নি। এমনকি নিজের গড় মুর্শিদাবাদেও মুখ থুবড়ে পড়েছে অধীর ম্যাজিক। সূত্রের খবর, প্রাথমিকভাবে বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দূরত্ব চাননি কংগ্রেস হাইকমান্ড। এমনকি রাজ্য কংগ্রেসের একটি অংশও একুশের ভোটে বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের প্রস্তাব দিয়েছিল। মূলত অধীরের আপত্তিতেই সেই সমঝোতা হয়নি। তবে বিধানসভা ভোটের পর থেকে অনেকটাই সুর নরম করতে দেখা গেছে বহরমপুরের সাংসদকে। আর লোকসভার দলনেতা থেকে তাঁকে সরানোর গুঞ্জন ওঠার মাঝে একেবারে ভোল বদলে তৃণমূলের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেল অধীরবাবুকে।
রাজ্যাল জগদীপ ধনখড়ের অতিসক্রিয়তা নিয়ে সরব হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যপালের অপসারণ চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদের প্রতিনিধি দল দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন. সোমবার এই নিয়ে তৃণমূলের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ অধীর চৌধুরী। সংসদে আগামী বাদল অধিবেশনে তৃণমূল সাংসদদের এ বিষয়ে সোচ্চার হবার আবেদনও করেছেন তিনি। একই সাথে সুপ্রীম কোর্টে যাবার পরামর্শও দিয়েছেন। এখানেই থেমে থাকেননি অধীর চৌধুরী। দেশের সলিসিটর জেনারেলের সাথে নারদ মামলায় অভিযুক্ত রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাক্ষাৎ আইনবিরুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সলিসিটর জেনারেলের বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে আনার দাবিও জানিয়েছেন অধীর। স্পষ্টতই দুটি কাণ্ডে তৃণমূলের পাশেই দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে লোকসভার কংগ্রেস দলনেতাকে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কয়েকদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা শোনা গিয়েছিল অধীর চৌধুরীর মুখে। কলকাতার বিধান ভবনে এক সাংবাদিক বৈঠকে বহরমপুরের সাংসদকে বলতে শোনা যায়, ‘এই মুহূর্তে একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠেকাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। ধর্মনিরেপেক্ষ ভাবে কংগ্রেস, সিপিএম এগোলেও রণকৌশলগত ভাবে ভোট দিয়ে মোদীকে হারানোর পরিকল্পনা করতে হবে। বিজেপি নামক সাম্প্রদায়িক দলকে ঠেকাতেই মুসলিমরা ভোট দিয়েছেন দিদিকে। মোদীকে ঠেকাতে দিদিই হলেন সেরা বিকল্প, তাই তাঁরা দিদিকে সমর্থন করছেন।’ ভবানীপুরে উপনর্বিচানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী না দেওয়ারও ইচ্ছেপ্রকাশ করেছেন অধীর। এইসব থেকেই প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি তীব্র মমতা বিরোধিতা থেকে এবার সরে আসছেন প্রদেশ সভাপতি। অধীর চৌধুরীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত বিরোধিতা অনেকবার চোখে পড়েছে। দিল্লিতে গেলে পাঁচবারের সাংসদ মমতা সংসদে পুরনো সতীর্থদের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু সেখানে কখনই অধীরের সঙ্গে মমতাকে দেখা করতে দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কংগ্রেস ছাড়লেও এখনও সনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মমতার সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল বলেই জানা যায়।
মমতা ও অধীরের মধ্যে এই দূরত্বের প্রভাব পড়েছিল লোকসভার অধিবেশনেও। লোকসভায় সব থেকে বড় বিরোধী দল কংগ্রেস। তারপরেই রয়েছে তৃণমূল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, একে অপরের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি দুই দল। সরকারকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও তেমন ভাবে জোট বাঁধেনি দুই শিবির। দুই তরফের ব্যক্তিগত বিরোধিতার কারণেই বরফ গলেনি বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। এদিকে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে কেন্দ্রে মোদী বিরোধী মুখ হিসেবে বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চাইছে একাধিক বিরোধী শিবির। বাংলায় তৃণমূলের দাপট দেখে মমতা প্রশংসায় মুখর হয়েছে অনেক সরকার বিরোধী দলই। আবার সমস্ত সরকার বিরোধীদলগুলোকে একজোট হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। আর এই আবহেই তৃণমূল নেত্রীকে চাঁচাছোলা আক্রমণের লাইন থেকে সরতে চাইছেন কংগ্রেস সুপ্রিমোও। ২০২৪-কে পাখির চোখ করে এখন থেকেই পদক্ষেপ শুরু করতে মরিয়া সনিয়া। আর তাই তিনি লোকসভার দলনেতার আসনে বদল আনতে চাইছেন। এমন খবর রটলেও দলের তরফে তা অবশ্য ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হচ্ছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে মুখ খুলেছেন অধীরও। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দাবি করেছেন, 'এই ধরণের কোনও তথ্য আমার কাছে নেই। আমি দলের একজন সৈনিক। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ মেনেই চলব।' পাশাপাশি বহরমপুরের সাংসদের আরও সংযোজন, 'আমি সামান্য ব্যক্তি, দলের শীর্ষনেতৃত্ব আমায় যা দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন, তা পালন করাই আমার ধর্ম।'
অধীরের বিজেপি নৈকট্য নিয়ে অতীতে বহুবার চর্চা হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অধীর চৌধুরীকে 'দাদা' সম্বোধন করে তাঁর সঙ্গে মধুর সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়েছেন। এই আবহে প্রদেশ সভাপতি হিসাবেও অধীরকে নিয়ে দলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। কয়েকদিন আগেই অধীরের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন গত বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। অধীরকে সরাসরি মিথ্যেবাদী বলে আক্রমণ করেন প্রবীন এই কংগ্রেস নেতা। সোমবার দল ছাড়ার আগে অধীরের নাম না করলেও এ রাজ্যে কংগ্রেসের যে কিছু হওয়ার নেই তা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন প্রণব পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে অধীর তৃণমূলকে নিয়ে তাঁর অবস্থান বদল করছেন বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের।