প্রশান্ত কিশোর, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন হয়ে যাবার পরেই ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আর এই কাজ করবেন না। অর্থাৎ, নির্বাচন পরিচালনা, কৌশল রচনা— এইসব কাজ থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবেন। সেই মতো তাঁর সংগঠন, ‘আই প্যাক’-এর প্রধানের পদে যে তিনি বহাল ছিলেন, সেখান থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এতো সহজে প্রশান্ত কিশোরকে ছাড়তে রাজি নন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, প্রশান্ত কিশোরকে থাকতে হবে। প্রশান্ত কিশোর না থাকলেও, তাঁর ‘আই প্যাক’ নামক একটা সংস্থা আছে, তাঁর একটা টিম আছে, তাঁর একটা নেতৃত্ব আছে। তারা কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আনুষ্ঠানিকভাবেও তাঁদের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের যে সম্পর্ক, সেটা রাখতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও অত্যন্ত উৎসাহী।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে রাজনীতি, তাঁর যে দৈনন্দিন কার্যকলাপ, সেটা ক্রমশ বাড়ছে। তিনি এখন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তিনি এখন পিকে-র ‘স্টাইল অফ ওয়ার্ক’-এর সঙ্গে অবহিত হয়ে, সেটা অনুসরণ করছেন তাঁর দৈনন্দিন কার্যকলাপে। অভিষেকের দৈনন্দিন কার্যকলাপ ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেস একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দিন থেকেই বিজেপি, বিরোধী দল হলেও খুব আক্রমণাত্মক! শপথ গ্রহণের দিনেও, রাজ্যপাল যেভাবে মমতার সামনেই রাজনৈতিক হিংসা উত্থাপন করেন, যেভাবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘটনা ঘটল এবং যেভাবে শুভেন্দু অধিকারী, প্রতিনিয়ত কখনও রাজ্যপালের কাছে যাচ্ছেন, কখনও নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ-এর সঙ্গে বৈঠক করছেন, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা থাকছেই।
পশ্চিমবঙ্গ, বিজেপির জন্য এখনও ল্যাবরেটরি। তাদের যে মিশন বাংলা, সেটা এবারে অসফল হলেও, তারা কিন্তু এখনও হাল ছাড়েনি। এর পরেই আসবে পুর নির্বাচন এবং বেশ কিছু উপনির্বাচন। এমনকী, ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপনির্বাচনও আসন্ন। তার ফলে, এখন পরিস্থিতিটা যথেষ্ট ঘোরালো। ঠিক সেই কারণে পিকে-কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখনও প্রয়োজন।
শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও পিকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে আছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সম্প্রতি পিকে মহারাষ্ট্রে গিয়ে, বম্বেতে শরদ পাওয়ারের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টার বৈঠক করেছেন। সেখানে শরদ পাওয়ারের কন্যা, সুপ্রিয়া সুলে এসেও যোগ দেন। সেখানে তাঁরা মধ্যাহ্ন ভোজনও করেন। তারপর রাতে শাহরুখ খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মহারাষ্ট্রের যে রাজনীতি, সেখানে পিকে, শরদ পাওয়ার-কে যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা মমতার সঙ্গে কথা বলেই করেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাইছেন, রাহুল গান্ধী কোনোভাবেই যেন মহারাষ্ট্র সরকারের থেকে সমর্থন তুলে না নেন। মহারাষ্ট্রে যদি সরকার পড়ে যায় তাহলে কিন্তু বিজেপি, শিবসেনার সঙ্গে, এমনকী, শারদ পাওয়ারের সঙ্গেও রফা করে, একটা সরকার বানিয়ে ফেলবে। সেটা কিন্তু মোদীর ২০২৪-এর জন্য ভালো। ক্ষমতায় থাকাটা কিন্তু জরুরি। সেই কারণে কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীকে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পিকে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
অন্য দিকে কংগ্রেসের মধ্যে একটা অংশ আছে, যাঁরা মনে করেন, সমর্থন তুলে নিলে কংগ্রেসের নিজস্বতা থাকবে, নিজস্ব শক্তি থাকবে। এখানে শিবসেনার লেজুড়বৃত্তি করে, কংগ্রেস তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে। এই টানাপোড়েনে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত কী করে? এটা এখন দেখার বিষয়!
এরপর যেটা গুরুত্বপূর্ণ, ত্রিপুরার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্য, বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় এসেছে। এর আগে তৃণমূল ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এইবারে তৃণমূল বেশ আটঘাট বেঁধে নামছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রাক্তন মন্ত্রী, সমীর বর্মণের পুত্র, সুদীপ বর্মণের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস যোগাযোগ করছে। সেখানে যদি কোনোভাবে বিজেপি দলকে তাঁরা ভেঙে দিতে পারে তাহলে কিন্তু এই বদলা নেওয়ার কাজটা চলতেই থাকবে। যেমন বলা হয়, রাজনীতিতে বদলা নেওয়ার খেলা চলতেই থাকে।
এই বিজেপি, দল ভাঙার খেলা খেলেছে এবং বারবার তৃণমূলকে ভাঙার চেষ্টা করেছে। এখন আবার বিজেপি ভেঙে তৃণমূলে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই খেলাটা সফল হবে, কি, হবে না— সেটা এখন দেখার বিষয়। কেননা, ৭৭টা আসন কম নয়। ৭৭টা আসন ভাঙতে গেলে, তার জন্য যে ১/৩ মেজরিটি লাগে, সেটা পাওয়া কিন্তু এতো সহজ কাজ নয়। আবার অন্যদিকে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ২০২৪-এর আগে আঞ্চলিক দলগুলোকে একজোট করা, সেটাও একটা মস্ত বড় কাজ। কেননা, পাঞ্জাবে মায়াবতী এবং আকালি দলের মধ্যে জোট হয়েছে। এই জোটটা তৃতীয় ফ্রন্ট, তারা কাকে সাহায্য করবে? কংগ্রেসকে, না, বিজেপিকে? এটা একটা মস্ত বড় প্রশ্ন।
আকালি নেতা, সুখবিন্দর সিং বাদল, ঘোষণা করেছেন, আঞ্চলিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গোটা দেশে এককভাবে নিজেদের দলকে প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা করছে, তাতে আঞ্চলিক দল বা আঞ্চলিকতা গোল্লায় যাচ্ছে। তার ফলে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, যেটা আমাদের প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, তাতে ঐক্য রক্ষার নামে শক্তিশালী কেন্দ্র হচ্ছে, কিন্তু বৈচিত্র্যকে আর রক্ষা করা হচ্ছে না। অর্থাৎ, আঞ্চলিক যে স্বকীয়তা, তাতে সেই রাজনৈতিক পরিসর অবলুপ্ত হচ্ছে। সেই কারণে এখন একজোট হয়ে আঞ্চলিক দলগুলোকে একত্রিত হতে হবে। সেই চেষ্টাটা শুধু বাদল নয়, নীতিশ কুমারের মতো বিজেপির সঙ্গে থাকা লোকও কিন্তু নড়েচড়ে বসছে।
আবার দেখা যাচ্ছে, শিবসেনা, এনসিপি, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি— এসমস্ত দলগুলো কিন্তু একত্রিত হচ্ছে এবং এই একত্রিত করার কাজটি করছেন পিকে। কারণ, পিকের সঙ্গে স্ট্যালিনের খুব ভালো সম্পর্ক। তিনি স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। এরপরে পাঞ্জাবে, ক্যাপ্টেন অমরিন্দরের সঙ্গেও তিনি দেখা করবেন। কেজরিওয়ালের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তামিলনাড়ুতে, স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করে, তাঁকেও তিনি এই নতুন জোটে সামিল করবেন।
সুতরাং, এইভাবে ধীরে ধীরে একটা ইউপিএ-কে পুনরুজ্জীবিত করা হবে এবং সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতীয় রাজনীতি কোন পথে এগোবে, সেটা ভেবে পিকে আবার একটা নতুনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং নতুন ভূমিকা নেবেন। এখন এটাই দেখার, আগামী দিনে প্রশান্ত কিশোরকে আমরা কী ভূমিকায় দেখতে পাব?