কেন্দ্রের সর্বদলীয় কূটনৈতিক সফরে ইউসুফ পাঠানের নাম পাঠিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁর নাম গ্রহণও করে কেন্দ্র। পাসপোর্টের নথিও চেয়ে নেওয়া হয়। এসে যায় সফরসূচি। কিন্তু এরপরেই হঠাৎ বেঁকে বসল তৃণমূল নেতৃত্ব। প্রতিনিধি না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল ঘাসফুল শিবির। বরং কূটনৈতির কার্যকলাপ যে কেন্দ্রেরই কাজ, সেটাও স্পষ্ট করে দিলেন ডেরেক ও'ব্রায়েন।
অবশ্য শুধু তৃণমূলই নয়। ‘অপারেশন সিঁদুরে’র পর, কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বদলীয় কূটনৈতিক সফরের সিদ্ধান্তে দেশজুড়ে তুঙ্গে রাজনৈতিক তরজা। রবিবার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয় শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী) এবং কংগ্রেস। বিরোধীদের অভিযোগ, আমেরিকার চাপ এবং পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় দেশজুড়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা থেকে জনতার নজর ঘোরাতেই বিজেপি সব দলকে নিয়ে বিদেশ সফরের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে কূটনৈতিক কৌশলের গন্ধ পাচ্ছেন তাঁরা।
শিবসেনা (উদ্ধব) এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য, এই সর্বদলীয় কূটনৈতিক সফর আসলে বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলের অঙ্গ। শাসক দল নিজেদের স্বার্থেই এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
ইউসুফ পাঠান যাবেন বলে তৈরিই ছিলেন...
তৃণমূল কংগ্রেস প্রথমে এই প্রতিনিধিদলে লোকসভার সাংসদ ইউসুফ পাঠানকে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল। বিদেশ মন্ত্রক ও সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর তরফে ইউসুফ পাঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর পাসপোর্ট সংক্রান্ত নথি সংগ্রহ করা হয়। এমনকি এই সফরের সম্ভাব্য সূচিও দেখে নেন ইউসুফ। জানা যায়, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়ায় যে গ্রুপ থ্রি ডেলিগেশন টিম যাবে, সেই দলেই ইউসুফ থাকবেন।
কিন্তু রবিবার তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়ে দেয়, এই সফরে তাঁদের কোনও প্রতিনিধি যাবেন না।
এই বিষয়ে তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, 'আমরা সর্বদা দেশের ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতি পরিচালনা করা কেন্দ্রের দায়িত্ব। সেটা তারাই করুক।' দলীয় সূত্রে আরও বলা হয়, তৃণমূল একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল এবং কারা কোনও প্রতিনিধিদলে যাবেন, তা বিজেপি বা কেন্দ্র ঠিক করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সাংসদের সঙ্গে দলনেত্রী বা নেতৃত্বকে না জানিয়ে ফোন করে পাসপোর্ট চাওয়াটা মোটেও ভাল চোখে দেখছে না তৃণমূল।
অন্যদিকে শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী)-র নেতা সঞ্জয় রাউত এই বিদেশ সফরকে ‘বরযাত্রী’(বারাত) বলেও কটাক্ষ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, 'এভাবে বরযাত্রী পাঠানোর প্রয়োজন কী? প্রধানমন্ত্রীর এমন তাড়াহুড়ো করার কোনও দরকার ছিল না। উপ-মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে শ্রীকান্ত শিন্ডে বিদেশে গিয়ে কীসের প্রতিনিধিত্ব করবেন?' সঞ্জয় রাউত আরও বলেন, 'বিজেপি যেকোনও বিষয়কেই রাজনীতির মঞ্চে টেনে নিয়ে আসে। ইন্ডিয়া জোটের উচিত এই বরযাত্রী বয়কট করা।'
শশী থারুরকে নিয়ে জলঘোলা কংগ্রেসেই
মার্কিন মুলুকে এই সফরের নেতৃত্বে রয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ এবং প্রাক্তন কূটনীতিক শশী থারুর। তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশ সফরের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এদিকে এর ফলে কংগ্রেসের অন্দরেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কংগ্রেস আগেই কেন্দ্রকে চারজন সাংসদের নাম পাঠিয়েছিল—আনন্দ শর্মা, গৌরব গগৈ, সৈয়দ নাসির হুসেন এবং রাজা ব্রার। কিন্তু এই তালিকার বাইরে গিয়ে সরকার শশী থারুরকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ে কংগ্রেস।
কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, 'কংগ্রেসে থাকা আর কংগ্রেসের হওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে।' তাঁর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী বা কিরেন রিজিজু যে আলোচনা করে নাম চেয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী তালিকা দিয়েছিল কংগ্রেস। তারপরও তা মানা হয়নি। বরং নিজের থেকেই শশী থারুরের নাম জানায় কেন্দ্র।
উল্লেখ্য, পহেলগাঁয়ের ঘটনায় ২৬ জন সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পরই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তান সমর্থিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে বিভিন্ন দেশে সাতটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হবে। বিভিন্ন পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সাংসদদের নিয়ে এই প্রতিনিধি দল গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্র সঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলিই মূলত এই সফরের তালিকায় আছে।
বিজেপি বিরোধী জোট এই কূটনৈতিক উদ্যোগে আদৌ অংশগ্রহণ করে কি না, এখন সেটাই দেখার। তবে এখনও পর্যন্ত বিরোধীরা একে 'রাজনৈতিক চাল' বলেই দেখছে।
কাদের নেতৃত্বে কোন ডেলিগেশন?
৭টি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকবেন -
শশি থরুর (কংগ্রেস)
রবিশঙ্কর প্রসাদ (বিজেপি)
বৈজয়ন্ত পাণ্ডা (বিজেপি)
সঞ্জয় কুমার ঝা (জেডিইউ)
কনিমোই করুণানিধি (ডিএমকে)
সুপ্রিয়া সুডে (এনসিপি, এসপি গোষ্ঠী)
শ্রীকান্ত শিন্ডে (শিবসেনা, শিন্ডে গোষ্ঠী)
Group-1 (সৌদি, কুয়েত, বাহরিন, আলজেরিয়া):
নেতৃত্বে বিজেপির বৈজয়ন্ত পাণ্ডা। দলে আছেন - নিশিকান্ত দুবে, ফঙ্গনোন কোন্যক, রেখা শর্মা, আসাদুদ্দিন ওয়েসি, সতনাম সিংহ, গুলাম নবি আজাদ ও হর্ষ শৃঙ্গলা।
Group-2 (ইউরোপের দেশগুলো):
নেতৃত্বে রবিশঙ্কর প্রসাদ। দলে আছেন - দগ্গুবতী পুরন্দেশ্বরী, প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী, গুলাম আলি খাটানা, অমর সিংহ, সমিক ভট্টাচার্য, এমজে আকবর ও পঙ্কজ সরণ।
Group-3 (ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়া):
নেতৃত্বে জেডিইউ-র সঞ্জয় কুমার ঝা। দলে আছেন - অপরাজিতা শারঙ্গি, ইউসুফ পাঠান(ছিলেন), বৃত লাল, জন ব্রিটাস, প্রধান বরুয়া, হেমাং জোশী, সালমান খুরশিদ ও মোহন কুমার।
Group-4 (ইউএই, লাইবেরিয়া, আফ্রিকার দেশ):
নেতৃত্বে শ্রীকান্ত শিন্ডে। দলে আছেন - বাঁসুরি স্বরাজ, ই.টি. মোহাম্মদ বশীর, অতুল গর্গ, সস্মিত পাত্র, মনন মিশ্র, এসএস আহলুয়ালিয়া ও সুজন চিনয়।
Group-5 (আমেরিকা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া):
নেতৃত্বে শশী থরুর। দলে আছেন - শাম্ভভি, ড. সরফরাজ আহমেদ, জি.এম. হরিশ, শশাঙ্ক ত্রিপাঠী, ভুবনেশ্বর কলিতা, মিলিন্দ দেবড়া, তরনজিৎ সিংহ, তেজস্বী সূর্য।
Group-6 (রাশিয়া, স্পেন, গ্রিস):
নেতৃত্বে কনিমোই করুণানিধি। দলে আছেন - রাজীব রায়, মিয়া আলতাফ, ক্যাপ্টেন চৌটা, প্রেমচাঁদ গুপ্ত, ড. অশোক মিত্তল, মঞ্জিভ পুরি ও জাভেদ আশরফ।
Group-7 (আফ্রিকা, মিশর, কাতার):
নেতৃত্বে সুপ্রিয়া সুলে। দলে আছেন - রাজীব প্রতাপ রুড়ি, বিক্রমজিৎ সাহনি, মনীশ তিওয়ারি, অনুরাগ ঠাকুর, লাভু শ্রীকৃষ্ণ, আনন্দ শর্মা, ভি. মুরলীধরণ ও সাইয়দ আকবরউদ্দিন।