প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত সপ্তাহে মোদী দুই দিনের সফরে ২৬ মার্চ বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তার এই সফর ঘিরে বাংলাদেশে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে প্রায় এক ডজন মানুষ প্রাণ হারান। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন, সরকারি অফিস এবং কয়েকটি মন্দিরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এই সহিংস প্রতিবাদের পিছনে ছিল উগ্র ইসলামী সংগঠন 'হেফাজতে ইসলাম' এর সমর্থকরা। (ছবি-AP)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফরের বিরোধিতাকারী 'হেফাজতে ইসলাম' গত কয়েক বছরে আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্যও বৃদ্ধি করেছে। এই সংগঠনের আওয়ামী লীগ থেকে আসা ৩৬ জন ব্যক্তিত্ব রয়েছে। আওয়ামি লিগ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল, যিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলেন। মহিলাদের অধিকার সম্পর্কিত বিল হোক বা বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করার বিষয়ই হোক না কেন, প্রতিটি মুহূর্তে এই সংগঠনটি শেখ হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এসেছে।
নিজেদেরকে ইসলামের রক্ষাকারী মনে করে হিফাজতে ইসলাম সংগঠনটি। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নিজেদের দাবি আদায় করতে সংগঠনটি সহিংস বিক্ষোভ অবলম্বন করে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মহিলাদের সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, ঋণ, জমির ভাগ প্রভৃতি বিষয়ে সমান অংশীদারির জন্য জাতীয় মহিলা উন্নয়ন নীতি বিল খসড়া করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী শেখ হাসিনার দল আওয়ামি লিগ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরে ধর্মনিরপেক্ষ লোকেরা সামরিক শাসনের সময় কার্যকর হওয়া সংবিধানের মূল চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার জন্য পঞ্চাশতম সংশোধনী বাতিল করার চেষ্টা করেছিল।
ক্ষমতায় আসার পরে শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। তবে বাংলাদেশে এই পরিবর্তনগুলি বিবেচনা করে ইসলামি মৌলবাদীরা মনে করেছিল যে রাজনীতিতে তাদের সুযোগ কমছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অনেক ইসলামী সংগঠন এক ব্যানারে এসে 'হেফাজতে ইসলাম' নামে একটি সংগঠন গঠন করে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটি চট্টগ্রামে মহিলা বিলের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়েছিল এবং সংবিধানের পঞ্চাশতম সংশোধনীর পক্ষে ছিল। এই বিক্ষোভ চলাকালীন, পুলিশের সাথে সহিংস সংঘর্ষে কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছিল। সেই দিন থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূমিতে জমিতে নতুন ইসলামী সংগঠনের অস্তিত্ব প্রকাশ পেতে শুরু করে।
'হেফাজতে ইসলাম' এর সদর দফতর বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রয়েছে, যেখানে কওমি মাদ্রাসা, শিক্ষার্থী ও সুন্নি আলেমদের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি সৌদি আরব থেকে আর্থিক সহায়তা পায়। ২০১০ সালে, হেফাজতে ইসলাম মহিলা বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তারপরে ২০১৩ সালে এর সমর্থকরা তাদের ১৩ দফা দাবির জন্য আবার ঢাকার রাজপথে নেমেছিল। সেই দাবির মধ্যে একটি ছিল মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর করা। তারা মহিলা বিল বাতিলেরও দাবি জানায়। তাদের দাবি ছিল জনসমক্ষে নারী-পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধ করা উচিত এবং পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়কে "অমুসলিম" ঘোষণা করা উচিত।
যদিও শেখ হাসিনার সরকার প্রাথমিকভাবে এই বিক্ষোভগুলি উপেক্ষা করেছিল, তবুও হেফাজতের সদস্যরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি মিছিল বের করে। যখন তাদের চাপ বাড়তে থাকে , সরকার কঠোর ভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করে। ২০১৩ সালের ৬ মে সুরক্ষা বাহিনী ঢাকা অবরোধ ধরা হেফাজতদের হঠাতে ব্যবস্থা নিয়েছিল। এই অভিযানে কমপক্ষে ১১ জন নিহত হন।
যেহেতু ঢাকার অবরোধ ব্যর্থ হয়েছিল, তাই হেফাজত কখনও সরকার বা শাসকদলের সাথে সরাসরি লড়াই করেনি। কিন্তু এই সংগঠনটি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী সংগঠন হিসাবে তার আধিপত্য বজায় রেখেছিল এবং ইসলামিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের প্রভাব এই বিষয়টি থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশে সংবিধানের পঞ্চাশতম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছিল, সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অন্যান্য অনুচ্ছেদ সহ মূল সংবিধান পুনরুদ্ধার করেছিল, তবে ইসলাম একটি ধর্মই থেকে যায়।
হেফাজত ইসলামকে দেশের প্রধান ধর্মি হিসাবে বিলুপ্ত করার বিষয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার হেফাজতের চাপে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করেছে। ২০১৫-১৬ সালে, যখন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার এবং মুক্তমনারা হিংসার শিকার হয়েছিল, হেফাজাত এই জাতীয় লেখকদের বিরুদ্ধে উস্কানি জুগিয়েছিল। ২০১৭ সালে, হেফাজতের দাবিতে, বাংলাদেশ সরকার সুপ্রিম কোর্ট চত্ববর থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি সরিয়ে নিয়েছিল। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেফাজতের সাথে জড়িত কিছু ইসলামী দল ১৯৯৪ সালে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল, যার ফলে তিনি দেশে ছেড়ে সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার সরকার জামাতে ইসলামীর চেয়ে হেফাজতেকে বড় সমস্যা হিসাবে দেখে না, তবে এটাও ঠিক যে এই সংগঠনি ধীরে ধীরে এই কয়েক বছরে আরও শক্তিশালী হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে প্রতিবাদ নামে সংগঠনটি। এমন একটা সময় তারা বিক্ষোভে সামিব হয় যখন ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করছে। ঢাকা ও নয়াদিল্লি উভয়ের কাছেই বাংলাদেশের উগ্র ইসলামী সংগঠনটি কিন্তু একটা বড় চ্যালেঞ্জ।