দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। শেষমেশ মুক্তি পেতে চলেছে বহু প্রতীক্ষিত ছবি 'অভিযাত্রিক' (Avijatrik)। ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার ও প্রশংসা কুড়িয়েছে শুভ্রজিৎ মিত্র (Shubhrajit Mitra) পরিচালিত এই ছবি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Bibhutibhusan Bandopadhyay) লেখা 'অপরাজিত' (Aparajito) উপন্যাসের শেষভাগ নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘অভিযাত্রিক’। সত্যজিৎ রায় ‘অপু ট্রিলজি’ (Apu Trilogy) যেখানে শেষ করেছিলেন, ১৯৫৯-র ‘অপুর সংসার’ (Apur Sangsar)-র সেই দৃশ্যের ঠিক পরের থেকেই শুরু এই ছবির চিত্রনাট্য।
'অভিযাত্রিক' ছবিতে অভিনয় করেছেন অর্জুন চক্রবর্তী, দিতিপ্রিয়া রায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, সব্যসাচী চক্রবর্তী, তনুশ্রী শংকর, সোহাগ সেন, বরুন চন্দ ও অন্যান্যরা। অপুর ভূমিকায় দেখা যাবে অর্জুন চক্রবর্তীকে (Arjun Chakrabarty)। ছবি মুক্তির কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। আজতক বাংলাকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে ছবি নিয়ে আড্ডা দিলেন 'অপু' ওরফে অভিনেতা অর্জুন।
আজতক বাংলা: 'অভিযাত্রিক' মুক্তির আগেই এত সম্মান ও প্রশংসা পেয়েছেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রেক্ষাগৃহে সর্ব স্তরের দর্শকরা এবার বিচার করবেন। টেনশন হচ্ছে?
অর্জুন: না, ঠিক সেরকম না। কটা ফেস্টিভ্যালে গেল, কটা অ্যাওয়ার্ডস পেল সেটা কখনই একটা ছবির মাপকাঠি হতে পারে না। তবে ভাল লাগছে ভেবে যে গ্লোবাল স্টেজে, শুধুমাত্র বিদেশের ভারতীয় কিংবা বাঙালিরা নয়, বিদেশীরাও আমাদের ছবি দেখেছেন এবং একটা স্বীকৃতি পেয়েছে ছবিটি। তবে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা এটা দেখতে পাবেন, সেটা সবচেয়ে আনন্দের।
প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের ঘরানার ছবি, তার মধ্যে 'অপু' হিসাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির মননে রয়েছেন। চরিত্রটি আপনার কাছে আসার পর কতটা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
অর্জুন: আমার কাজের একটা পদ্ধতি হল, চিত্রনাট্য ও পরিচালকের উপর নির্ভর করা। সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ওঁরা কিংবদন্তি। তবে তাঁদের মতোই করতে হবে এটা যদি সব সময় ভাবি, তাহলে অতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতাম না। আমরা নিজেদের মতো করে একটা ছবি বানাতে চেয়েছি। অবশ্যই যে চরিত্রগুলি গল্পে রয়েছে, তাঁদের নিয়ে ছবি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই চরিত্রগুলি নিয়ে, একেবারে আমাদের মতো করে এই ছবিটা বানানো হয়েছে। শুভ্রজিৎ দা কখনই দাবি করেননি যে, সত্যজিৎ রায়ের ছবির মতো ছবি বানাবেন। কিংবা আমিও বলিনি সৌমিত্র বাবুর মতো অভিনয় করব।
প্রশ্ন: আয়ুষ্মান, ছবিতে 'কাজল' অর্থাৎ আপনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছে। একজন শিশু শিল্পীর সঙ্গে এতটা সময় জুড়ে অভিনয় করা, কতটা কঠিন ছিল?
অর্জুন: সত্যি বলতে কঠিন মনে হয়নি। শুভ্রজিৎ দা, আয়ুষ্মানকে এত সুন্দর করে গাইড করেছিলেন। সেটে গিয়েও দৃশ্য অনুযায়ী কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সবটা ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ও খুব বাধ্য ছেলে। যা যা বলা হয়েছে, সেটা খুব ভাল ভাবে করেছে। আমার মনে হয় বাবা-ছেলের দৃশ্যগুলি সুন্দর ভাবে পর্দায় ফুটে উঠেছে এই কারণেই।
প্রশ্ন: ছোট পর্দার 'গোরা' থেকে বড় পর্দার 'অপূর্ব'! আপনার নিজের কতটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়?
অর্জুন: (হেসে) হ্যাঁ মাঝে মাঝে খুবই অবাক লাগে। ২০১০ -এ জার্নি শুরু করেছি, ১১ বছর হয়ে গেল। এত রকমের চরিত্রে অভিনয় করেছি। তবে অপুর চরিত্রে অভিনয় করার এই সুযোগটা পাওয়া একটা সাংঘাতিক সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি খুবই কৃতজ্ঞ ছবির প্রযোজক, পরিচালকের কাছে। সোহাগ সেন এবং বিক্রম ঘোষ খুবই সাপোর্ট করেছিলেন আমার কাস্টিংটা। এমনকী প্রথম ফোন আমায় বিক্রম দা করেছিলেন। তাই অনেকগুলি মানুষের সমর্থন পেয়েছি আমি। এবার আমার কাজ কতটা ভাল কিংবা খারাপ লাগল তা ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে আমরা জানতে পারব।
প্রশ্ন: আপনার অভিনীত এতগুলি চরিত্রের মধ্যে 'এটা' একটা মাইলফলক হিসাবে মনে করছেন। সাদা -কালো ছবিতে অভিনয় করা কি একটু বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল?
অর্জুন: 'অভিযাত্রিক' সাদা -কালোয় করার পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল। ১৯৩৯- ১৯৪০-র সময়কালটা তুলে ধরা... এবং যেহেতু এটা একটা সিক্যুয়েল বলা যায়, একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে, তাই সেই নস্ট্যালজিয়ার সঙ্গে রিলেট করতে অনেকটা সুবিধা হবে এতে সকলের। তবে সামনের বছর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'X=Prem' আসছে, সেটাও সাদা-কালোতে। যদিও সেটা একেবারে ২০২১ সালের অর্থাৎ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা গল্প।
প্রশ্ন: সব ছবি থেকেই অভিনেতাদের সঙ্গে কিছু না কিছু থেকে যায়। এক্ষেত্রে 'অভিযাত্রিক-র কী আপনার সঙ্গে রয়ে যাবে?
অর্জুন: যে কোনও বিশেষ একটা কিছু বলা খুব কঠিন এক্ষেত্রে। অবশ্যই প্রথমত, অপুর চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া। সেই সঙ্গে বাবার সঙ্গে বড় পর্দায় প্রথম বার এক সঙ্গে কাজ করতে পারা... এটাও খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: আপনার বাবার (সব্যসাচী চক্রবর্তী) সঙ্গে বহুদিন পর স্ক্রিন শেয়ার করলেন এই ছবিতে। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
অর্জুন: 'গানের ওপারে' ধারাবাহিকের পর এই ছবিতেই একসঙ্গে অভিনয় করলাম আমরা। বড় পর্দায় এই প্রথম বাবার সঙ্গে কাজ। যে চরিত্রের জন্য শুভ্রজিৎ দা বাবাকে বেছে নিয়েছেন, সেটা সত্যিই দারুণ। আমার বিশ্বাস, ছবিটা দেখার পরে সকলেই একমত হবেন, বাবার মতো একজন ব্যক্তিত্ব ছাড়া ওই চরিত্রটা ঠিক হত না। আর ব্যক্তিগতভাবে পরিবারের কারও সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে, আমার নিজের খুব সুবিধা হয়। বাবার ছেলে হিসাবে যদি নাও বলি, সব্যসাচী চক্রবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে একজন কিংবদন্তি। তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন স্পেস শেয়ার করাটা যে কোনও অভিনেতার জন্য একটু নার্ভাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেখানে আমার ব্যক্তিগত সমীকরণ কাজে দিয়েছে।
প্রশ্ন: বাবা কি বকা-ঝকা করেন সেটে, কোনও ভুল হলে?
অর্জুন: একেবারে না! ওটাই মজার ব্যাপার। প্রতিটা ছবির সেটেই খুব হৈহৈ করে কাজ করেন। গল্প করেন, বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলেন... ওঁর সঙ্গে কাজ করতে সকলেরই ভাল লাগে। আমার তো খুবই সুবিধা হয়েছে।
প্রশ্ন: একেবারে অন্য জঁনারের ছবি। তবুও শ্যুটিংয়ের সময়, সেটে কতটা মজা করে কাজ করেছিলেন?
অর্জুন: খুব মজা হয়েছে। আর অনেকগুলো জায়গায় ঘোরা হল। ছবির নামেই আছে 'ওয়ান্ডার লস্ট অফ অপু'! সবকটা রিয়েল লোকেশনে শ্যুটিং হয়েছে। উত্তরবঙ্গ, বেনারস, বোলপুর, টাকি, কলকাতা তো বটেই...তিন মাস ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এতগুলো জায়গায় কাজ করেছি আমরা।
প্রশ্ন: অপুর সঙ্গে অর্জুনের কোনও মিল আছে?
অর্জুন: আমিও ব্যক্তিগতভাবে একটু ভাবুক প্রকৃতির। সেটা খুব রিলেট করতে পেরেছিলাম। অপূর্ব কুমার অত্যন্ত ভাল একজন বাবা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে, একজন ভাল বাবা হওয়ার চেষ্টা করছি। তবে হতে পেরেছি কিনা, সেটা মেয়ে বড় হয়ে বলতে পারবে (হেসে)। এছাড়া ছবিতে যে সময়কাল ধরা হয়েছে, এখনকার অর্জুন চক্রবর্তী আর তখনকার সময়ের অপূর্ব কুমার রায়ের একই রকম হওয়া খুব মুশকিল।
প্রশ্ন: কতটা আশাবাদী এই ছবি নিয়ে?
অর্জুন: গত কয়েকদিনে যে কটা ছবি মুক্তি পেয়েছে, ভাল সাফল্য পেয়েছে। সুতরাং দর্শকরা যদি এই সাপোর্টটা করে যান, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে বাংলা ছবি আরও বড় জায়গায় যাবে। হিন্দি ছবি অবশ্যই চাকচিক্য কিংবা ব্যবসার দিক দিয়ে অনেক ভাল করছে। তবে যদি কনটেন্ট হিসাবে ধরা হয়, আমরা (বাংলা ছবি) সেরা না হলেও, একই রকমভাবে ভাল। তাই আমার ছবি রিলিজ করছে বলে তো বটেই, এছাড়াও আমি মনে করি দর্শকদের বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানো উচিত এভাবেই। এই সময় দাঁড়িয়ে, ওটিটি -তে পরে সব ছবি আসবে নিশ্চই। কিন্তু যখন এত কষ্ট করে একটা ছবি সিনেমা হল অবধি নিয়ে আসা হচ্ছে, তাই একটু সাপোর্ট পেলেই, আমরা আরও ভাল কাজ করতে সাহস পাবো।