চোখে-মুখে আক্রোশ নিয়ে একের পর এক ছুরির আঘাত। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে যুবতীর দেহ। মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। কিন্তু, ছুরি চালানো থামাচ্ছে না সেই যুবক। আক্রমণকারী যুবককে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আশপাশের লোকজন। কিন্তু সে কর্ণপাত করছে না। একের পর এক ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে যুবতীর দেহ। অথচ পুলিশ সূত্রে খবর, তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুতপা চৌধুরীকে ভালোবাসত অভিযুক্ত সুশান্ত চৌধুরী। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। একই কথা জানিয়েছেন, সুশান্তের পরিবারের সদস্যরা।
তাহলে কী এমন ঘটল যে সুশান্ত নিজের প্রেমিকাকেই এমন নৃশংসভাবে খুন করল? কীভাবে সুশান্তের ভালোবাসা বদলে গেল প্রতিশোধে? এই প্রশ্নর উত্তর খুঁজতে নেমে একের পর এক চমকে দেওয়ার মতো তথ্য পাচ্ছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, সুশান্ত ও সুতপার মধ্যে সম্পর্ক ছিল। আর তা বেশ কয়েক বছরের। সংবাদমাধ্যমের সামনে দুই পরিবারের সদস্যরা তা স্বীকারও করে নিয়েছেন। তবে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় কিছুদিন আগে থেকেই। আর তাতেই চটে যায় সুশান্ত।
কেন সুশান্তর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় সুতপার? তার পিছনেও রয়েছে একাধিক কারণ। স্থানীয় সূত্রে খবর, তা জানতে গেলে ফিরতে হবে ফ্ল্যাশব্যাকে। পুরাতন মালদা ব্লকের বলরামপুরের বাসিন্দা সুশান্ত। পড়াশোনায় ভালো ছেলে বলেই পরিচিত ছিল সে। সুশান্ত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মালদা শহরের ITI-তে ভর্তি হয়। শহরের এয়ারভিউ কমপ্লেক্সের সামনেই তার পিসির বাড়ি। সেখানেই থাকতে শুরু করে। আর এয়ারভিউ কমপ্লেক্সে থাকত সুতপাও। সেই সূত্রেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা। যা প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। এতদূর পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সুতপার পরিবার।
স্থানীয় সূত্রে খবর, সুতপার বাবা, পেশায় শিক্ষক স্বাধীন চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। সেই কারণে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সুতপা। সেই থেকে সুশান্তর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করে।
বছর তিনেক আগে সুতপা পদার্থবিদ্যা নিয়ে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হয়। এদিকে সুশান্তও পটনার একটি কলেজে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়। সেখানেই সে পড়াশোনা করতে থাকে। পিসির বাড়িতে থাকা তখন থেকেই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সুতপা বহরমপুরে থাকে তা জানত সুশান্ত। তখন সেও বহরমপুরে যাওয়া আসা শুরু করে। এই খবর জানতে পারে সুতপার পরিবারও।
আর তাতে দুশ্চিন্তা বাড়ে সুতপার পরিবারের সদস্যদের। সুতপার বাবা জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও তা মেনে নেয়নি সুশান্ত। সে সুতপাকে হুমকি দিত। ভয় দেখাত। সেই কারণে তাঁদের এলাকায় কিছুদিন আগে সালিশি সভাও বসানো হয়। স্থানীয় কাউন্সিলর ও অন্যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
যদিও উল্টো অভিযোগ সুশান্তর পরিবারের সদস্যদের। অভিযুক্তের কাকিমা পুতুল চৌধুরীর দাবি, 'সুশান্তকে একাধিকবার মারধর করিয়েছে সুতপার বাড়ির লোকজন। ল্যাপটপ, মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছে। সুতপাও সুশান্তকে ভালোবাসত। প্রায় ২ বছর সম্পর্ক ছিল ওদের। মেয়েটা ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিল। ও ভালো ছেলে ছিল। কিন্তু, সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে সুশান্ত সবসময় বিচলিত থাকত।'
সুতপা ও সুশান্তর পরিবার এই দাবি করলেও পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় সুশান্ত জানিয়েছে, তার সঙ্গে সুতপার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তা মেনে নিতে চায়নি সুতপার পরিবার। পুলিশ সূত্রে এও খবর, সুশান্ত দাবি করেছে, সুতপা কয়েক মাস আগে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই রোষ থেকেই সে খুন করে সুতপাকে।
এখন প্রশ্ন তাহলে কি পূর্ব পরিকল্পনা করে প্রেমিকাকে খুন করেছে সুশান্ত? পুলিশ সূত্রে খবর, পূর্ব পরিকল্পনার কোনও প্রমাণ সুশান্তকে প্রাথমিকভাবে জেরা করে পাওয়া যায়নি। সুতপা কোন মেসে থাকত তা আগে থেকেই জানত সুশান্ত। তাই সে সেখানে হাজির হয়। বহরমপুরে সুশান্ত আসে রবিবার। সে এক গেস্ট হাউসে ওঠে। সুতপা যে এলাকায় থাকত তা বেশ জনবহুল। কাছেই সুইমিং ক্লাব। রয়েছে একাধিক দোকানও। তাও জানত সুশান্ত। সে ঘটনাস্থলে আসে সোমবার সন্ধে নাগাদ। সেখানে প্রায় ৩ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সুতপাকে মেস থেকে ডেকে আনে। এবং নৃশংসভাবে খুন করে।
খুনের পর নিজের হাতে থাকা নকল বন্দুক দেখিয়ে এলাকাবাসীদের ভয় দেখিয়ে চম্পট দেয় সুশান্ত। বহরমপুর থেকে রঘুনাথগঞ্জ পর্যন্ত একটি গাড়িতে যায়৷ তারপর রঘুনাথগঞ্জের অমরপুর থেকে অন্য একটি গাড়িতে ওঠে৷ সামসেরগঞ্জের কাছে পুলিশি নাকা চেকিংয়ের সময় ধরা পড়ে যায়। সেই সময় সে খুনের কথা স্বীকার করে নেয়। পুলিশকর্মীদের প্রশ্ন করে, 'সুতপা কি মারা গিয়েছে?'
ধরা পড়ার পর কেমন আচরণ করছে সুশান্ত? বহরমপুর থানার এক পুলিশ কর্তার কথায়, 'সুশান্তর মধ্যে কোনও অনুতাপ দেখা যায়নি। নির্লিপ্তই রয়েছে। কথা কম বলে। খুন করেছে বলে কোনও অনুশোচনা দেখা যায়নি ওর মধ্যে।'
মঙ্গলবার ধৃত সুশান্তকে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে বহরমপুর মহকুমা আদালত। বহরমপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সম্পর্কের টানাপোড়েন ছাড়াও অন্য কোনও কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।