দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বিশ্বের প্রায় সবকটি শক্তিশালী দেশই উচ্চ প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যের প্রয়োজন বোধ করেছিল। বোঝা গিয়েছিল, শুধু সেনাসদস্যদের সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেই হবে না, এমন কিছু কিছু অভিযানের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যার জন্য কড়া প্রশিক্ষণের দরকার। ২১ শতকে বিশ্বে সামরিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা অন্যান্য দেশের মতো ভারতের হাতেও এই রকম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ বাহিনী। যার মধ্যে অন্যতম MARCOS।
গত মে মাস থেকে চিনের সঙ্গে লাদাখ নিয়ে চাপা উত্তেজনা রয়েছে ভারতের। লালফৌজের আগ্রাসনের আবহে পূর্ব লাদাখের প্যাংগং হ্রদের কাছে স্থলপথ ও আকাশপথে সুরক্ষা বাড়িয়েছে ভারতীয় সেনা। এবার প্যাংগং-এর সুরক্ষায় নৌবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো MARCOS-কে পাঠান হল লাদাখে। সেনা সূত্রে খবর, হ্রদের পাহারাদারির জন্য নৌবাহিনীর ওই বিশেষ কমান্ডোদের আধুনিক নৌকা-সহ নতুন সাজসরঞ্জাম দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে বিপজ্জনক বিশেষ বাহিনী হল মার্কোস বা মেরিন কমান্ডোস। পাহাড়-মরুভূমি-জঙ্গলের মতো স্থলভাগের যে কোন জায়গায় যুদ্ধের জন্য এই বাহিনী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সামুদ্রিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে তো তাদের বলা হয় সুপার এক্সপার্ট। এদের কাছে বিশ্বের সমস্ত রকম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকে। তবে এই মার্কোস বাহিনীর সদস্য হওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এই বাহিনীর সদস্য হতে গেলে মানসিক এবং শারীরিক দিক থেকে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করতে হবে, তবে এই বাহিনীর সদস্য হওয়া যাবে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব ব্যাপার। ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবার পর মাত্র ৫% সদস্যকে এই বাহিনীতে যুক্ত করা হয়।
এই বাছাইয়ের প্রক্রিয়াই বলে দিচ্ছে ট্রেনিং কতটা কঠিন হয়।এই বাহিনীর জওয়ানেরা সমস্ত ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। সন্ত্রাস দমন জলের তলায় যুদ্ধ করা এমন কি পণ বন্দীদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে থাকেন এই বাহিনী।
বাহিনীতে যোগ দিতে গেলে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছরের ট্রেনিং পাশ করতে হয়। কোন ব্যক্তি এই ট্রেনিং নেওয়ার জন্য যোগ্য কিনা সেটা দেখার জন্য তার আগে প্রি-ট্রেনিং করা হয়। শুধু এটাই নয় তিন দিন ধরে শারীরিক পরীক্ষা চলে। এই সমস্ত কিছু প্রক্রিয়া করার পর প্রায় ৮০ % আবেদনকারী এখানেই বাদ হয়ে যায়। এরপর পাঁচ সপ্তাহের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই ট্রেনিং থেকে বলা হয় ‘হেল-উইক’। এই বিশেষ ট্রেনিং এ ঘুমাতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না। মানসিক এবং শারীরিক দিক থেকে চাপে রাখা হয়। এর পরও যারা এই ট্রেনিং থেকে চালিয়ে যায় তারা একমাত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।
মুম্বাই এর আইএনএস অভিমুন্য তে এদের প্রথম ট্রেনিং শুরু হয়। এরপর আগ্রায় প্যারাট্রুপারের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরপর সবথেকে শেষে কোচির ডাইভিং স্কুলে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবার পর তাদের অ্যাডভান্স ট্রেনিং শুরু হয়। হাইজ্যাকিং, জঙ্গি হানা যুদ্ধের মতো আরও বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার ট্রেনিং দেওয়া হয় তাদেরকে। এছাড়াও প্যারা জাম্পিং এর পাশাপাশি ‘ফ্রিং ফল’ -এর জন্য অনেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অনেক বেশি উচ্চতা থেকে চওড়া ও সরু জায়গায় ঝাঁপ দেওয়ার ও ট্রেনিং দেওয়া হয় এই সময়। বিশ্বের মুষ্টিমেয় কয়েকটি সেনাবাহিনীর মধ্যে এই মার্কোস বাহিনী সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পিঠে নিয়ে প্যারা ড্রপিং এর মাধ্যমে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে সক্ষম।
এই মার্কোস বাহিনীদের হাই অলটিটিউড কমান্ডো কোর্স এর ট্রেনিং দেওয়া হয় অরুণাচলের প্রভাত ঘটক স্কুলে। মরু যুদ্ধ শেখানো হয় রাজস্থানের ডেজার্ট ওয়ারফেয়ার স্কুলে, শুধু এই নয় এই বাহিনীকে মিজোরামের জাংগল ওয়ারফেয়ার স্কুলে জঙ্গি দমনও শেখানো হয়।
মার্কোস বাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর SEAL কোর্সে সবার প্রথমে জায়গা করে নিয়েছে।এই বাহিনীর আরেকটা বিশেষত্ব রয়েছে এই বাহিনীতে একজন ব্যক্তি তিন থেকে পাঁচ বছর থাকতে পারে।বাহিনীর কাছে বিশ্বের সবথেকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র থাকে। এই বাহিনীর কাছে থাকে ইজরায়েলের Tavor TAR-21, যার সঙ্গে গ্রেনেড লঞ্চার যুক্ত থাকে। Tavor TAR-21 ছাড়াও মার্কোসের কাছে আরো আধুনিকতম অস্ত্র রয়েছে যেমন, Heckler & Koch MP5 মেশিন গান, SIG Sauer P226 ও Glock 17 পিস্তল এবং রয়েছে Druganov ও Galil স্নাইপার রাইফেল।
খুবই কঠিন থেকে কঠিনতম অপারেশন ক্ষেত্রে এই বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়। একবার এই বাহিনী জাফনা জেটি দখলের জন্য ১২ কিলোমিটার সাঁতরে যান। এরপর বন্দরে বিস্ফোরক নিয়ে উঠে এবং খুব সহজেই সাঁতরে ফিরেও আসেন। সব থেকে অবাক হওয়ার বিষয় হলো কেউ ধরাও পড়েনি বা আহত হয়নি। ১৯৮৮ সালে অপ ক্যাকটাস নামের একটি বিশেষ অপারেশনে এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ২০০৮ সালের মুম্বাৃই হামলা তে মার্কোস বাহিনী জঙ্গি নিধন চালায়।
মার্কোস বাহিনীর একটি বিশেষ রূপ রয়েছে এরা দাড়ি লাগিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে রাখে। তাই জঙ্গিরা এই মার্কোস বাহিনীকে ‘দাড়িওয়ালা ফৌজ’ বলে ডাকে। এই বাহিনী প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। তখন এই বাহিনীর নাম ছিল Indian Marine Special Forces (IMSF). তার দুবছর পর নাম বদলে নতুন নাম দেওয়া হয় Marine Commando Force (MCF).
পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) বরাবর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই নজরদারির দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ ফোর্স। রয়েছে ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের বিশেষ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। সেই সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার বিভিন্ন কৌশলগত এলাকায় আকাশপথের সুরক্ষা জোগাচ্ছে বায়ুসেনার স্পেশাল ফোর্স। যাতে চিনের তরফে ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এবার তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হল বিশ্বের অন্যতম সেরা বাহিনী মার্কোস।