হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন তিথিতে মা কালীর (Goddess Kali) বিভিন্ন রূপের পুজো করা হয়। দেবীর আরাধনা সর্বজনবিদিত। কোথাও শ্যামাপুজো, কোথাও শ্মশানকালী, কোথাও চামুণ্ডাকালী আবার কোথাও কৃষ্ণকালী রূপে পূজিত হন দেবী। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে হয় কালী পুজো (Kali Puja) বা শ্যামা পুজো (Shyama Puja)।
দক্ষিণেশ্বর, ঠনঠনিয়া, লেক কালীবাড়ি, তারাপীঠ, কামাখ্যা, কালীঘাট, কঙ্কালীতলা, ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে কালী মন্দিরে দীপান্বিত অমাবস্যায় বিশেষপুজোর আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ কালী মন্দিরগুলির (Kali Mandir) মধ্যে, গত কয়েক বছর ধরে দুটি মন্দিরের নাম খুব পরিচিত। যে কোনও অমাবস্যা তিথি তো বটেই, এছাড়াও প্রায় রোজই ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে মন্দির দুটিতে। এমনকী সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে রয়েছেন দুই মন্দিরের কালী মা। বিশ্বাস অনুযায়ী, মন থেকে ডাকলে মা কাউকে খালি হাতে ফেরান না। কথা হচ্ছে বড় মা (Boro Maa) এবং কলকাতার জীবন্ত কালী (Kolkatar Jibanta Kali) নিয়ে।
নৈহাটির বড়মা (Naihati Boro Maa)
'ধর্ম হোক যার যার, বড়মা সবার'। বড়মার খ্যাতি বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। চারিদিকে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে জাগ্রত বড়মা। এক অমোঘ টানে প্রতি বছর কালী পুজোর সময় হাজার হাজার ভক্ত মানত করেন, পুজো দেন, ভিড় জমান এক ঝলক শুধু বড়মাকে দেখার জন্য। অনেকে আবার মনোবাসনা পূরণ করার জন্য গঙ্গাস্নান করে প্যান্ডেলে দণ্ডি কাটেন। নৈহাটির অরবিন্দ রোডের ধর্মশালা বড় কালী ঠাকুরকেই স্থানীয়রা বড়মা বলে ডাকেন। বড় কালী সমিতি ট্রাস্টের কালীপুজোই আসলে বড়মার পুজো বলে পরিচিত।
বড়মা কেন নাম? আসলে এই কালী মূর্তির আকারে ও উচ্চতায় বিরাট, প্রায় ২২ ফুট উচ্চতা। প্রায় ধরুন ১৪ হাত উঁচু একটি কালীমূর্তি। এই কারণে এই দেবীকে বড়মা বলে ডাকেন সকলে। তবে এই পুজো আগে এতটা জনপ্রিয় ছিল না। রাস্তার ধারে রক্ষাকালী মূর্তিতেই পুজো করতেন একদল যুবক। নৈহাটিতে বড়মায়ের একটি স্থায়ী মন্দির রয়েছে। সেখানে নিয়মিত পুজো হলেও, আগে যে জায়গায় রক্ষাকালী পুজো করা হত কালীপুজোয়, সেখানেই প্রতি বছর মৃন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানেই পুজো করা হয়।
এই পুজো সার্বজনীন হলেও, কারও কাছ থেকে কখনও চাঁদা বা দক্ষিণা নেওয়া হয় না। দেবীর গায়ের গয়না থেকে ভোগ, পুজোর সামগ্রী,পুজোর সমস্ত খরচ করে থাকেন সাধারণ ভক্তরা। নৈহাটির বড়মায়ের গায়ে গয়না দেখলে অবাক হতে হয়। কারণ গোটা মূর্তিই সোনা- রুপোর বিভিন্ন আকারের গয়নায় মোড়া থাকে। শোনা যায়, বড়মা সোনা - রুপো ছাড়া আর কোনও ধাতুর অলঙ্কার পরেন না। তাই ভক্তরাই মনোবাসনা পূরণ করার জন্য বিভিন্ন সময় সোনা ও রুপোর গয়না মানত হিসেবে দিয়ে থাকেন। এবারও ১০০ কেজি সোনা ও ২০০ কেজি রুপোর অলঙ্কারে সজ্জিতা হবেন কৃষ্ণবর্ণ কালী প্রতিমা।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে, ভবেশ চক্রবর্তী ও তাঁর চার বন্ধু মিলে নবদ্বীপে ভাঙা রাস দেখতে যান। সেখানে গিয়ে বড় বড় মূর্তি দেখে বিস্মিত হয়ে, নৈহাটিতে একটি রক্ষাকালী মূর্তিকে বিশালাকার মূর্তি গড়ার পরিকল্পনা করেন। কথিত আছে, এই পুজো ভবেশ চক্রবর্তী স্থাপন করেছিলেন, তাই এই দেবীকে ভবেশ কালীও বলা হয়। প্রথমে সকলে ভবেশ কালীই বলে ডাকতেন, তারপর বিশালাকার মূর্তিকে বড়মা বলে অভিহিত করেন।
মা শ্যামসুন্দরী (Maa Shyamsundari)
উত্তর কলকাতার এক কালী মন্দিরের কথা বর্তমানে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মন্দির জুড়ে আছে অসংখ্য অলৌকিক কাহিনি। যা শুনলে গায়ে কাঁটা দিতে পারে। মানুষের বিশ্বাস, উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের শ্যামসুন্দরী কালী মন্দিরে আসলে কালী মায়ের জীবন্ত রূপ বিরাজ করে। এজ্ন্যে অনেকে এই মন্দিরকে জীবন্ত কালীর মন্দিরও বলেন।
এখানে কালী একটি ছোট্ট মেয়ে রূপে পূজিতা হন। তাই এই মন্দিরে অম্বুবাচি পালিত হয় না। এমনকী এখানে কোনও রকম মাছ-মাংস ভোগ দেওয়া হয় না। দু'বেলা মন্দিরে ভোগ রান্না করা হয়। মন্দিরের সেবায়েতরা বলেন, যত মানুষই মন্দিরে আসুক না কেন, কেউ প্রসাদ না নিয়ে যান না এখান থেকে। মায়ের নাকি স্বপ্নাদেশ ছিল, কেউ যেন খালি হাতে না যায়। কোনও দিন প্রসাদের উপাদান কম পড়লে ভিক্ষা করে হলেও ভক্তদের হাতে প্রসাদ তুলে দিতে হবে এমনই নির্দেশ মায়ের।
বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্যামসুন্দরী মা কখনও কাউকে খালি হাতে ফেরান না। সবার মনবাঞ্ছনা পূরণ করেন তিনি। অনেকে নাকি শ্যামসুন্দরী মাকে চোখের পলক ফেলতে দেখেছেন। মন্দিরের সেবায়েতরাও নাকি এই বিষয়টি বহুবার অনুভব করেছেন। অমাবস্যার রাতে নাকি দেবী কালী গোটা মন্দির জুড়ে হেঁটে বেড়ান। এমনকী কথাও বলেন ফিস ফিস করে। সেই শব্দ বহুবার শুনেছেন সেবায়েতরা। প্রতি অমাবস্যায় মাত্র একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়। পুজোর সময় শোনা যায় মায়ের নিশ্বাস। শুধু পুরোহিত বা সেবায়েতরা নন, অনেকেই নাকি শ্যামসুন্দরীর উপস্থিতি অনুভব করেছেন। প্রতি অমাবস্যায় দূর থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন উত্তর কলকাতার এই অলৌকিক মন্দিরে।
কালীপুজো ২০২৪ -এর নির্ঘণ্ট (Kali Puja 2024 Date- Time)
* কালীপুজোর তারিখ - ৩১ অক্টোবর (১৪ কার্তিক), বৃহস্পতিবার।
* অমাবস্যা তিথি - ৩১ অক্টোবর, ঘ ৩/৭/৪২ থেকে ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৫/৮/৭ মিনিট পর্যন্ত অমাবস্যা তিথি থাকবে।