scorecardresearch
 

'পুরীর রথযাত্রার ডায়েরি' পর্ব ১: পুরীর রাজা সোনার ঝাঁটা দিয়ে ২২টি সিঁড়ি ঝাঁট দিলেন

পুরীর এই রথযাত্রার সময় অলিতে-গলিতে জিবেগজার দোকান। আগে দোকানদারেরা মন্দির থেকে সমুদ্র, সর্বত্র নানারকম দোকান দিয়ে থাকে। এটা আমি যতবারই পুরতে এসেছি, দেখেছি। কিন্তু দোলযাত্রার সময় যাদের দোকান নেই, যারা সাধারণ গৃহবাসী, তারাও অনেকে গৃহবধূ, তাদের মেয়েরা প্রচুর পরিমাণে জিবেগজা তৈরি করে ঢেকে রেখে বিক্রি করতে শুরু করে।

Advertisement
পুরীর রথযাত্রার ডায়েরি ২০২৪ পুরীর রথযাত্রার ডায়েরি ২০২৪
হাইলাইটস
  • এবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এসেছেন
  • অনেকে আবার জলের মধ্যে গোলাপ জল মিশিয়ে দিয়েছে
  • মহারাজা গজপতি বীরকিশোর দেব হলেন পুরীর রাজা

আজ রথযাত্রা। জগন্নাথ দেব তাঁর গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে রথে চেপে চলেছেন মাসীর বাড়ি। সঙ্গে দাদা বলরাম আর বোন সুভদ্রা। তিনজনে তিনটি পৃথক রথ। আর সেই রথযাত্রার সঙ্গী হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ। উপচে পড়া মানুষ চলেছে ও চলেছে। শ্রীক্ষেত্রের এই রথযাত্রা অনুষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে পুরীতে আজ যেন কুম্ভমেলা। 

গতকাল দুপুর থেকেই মন্দিরে সাজো সাজো প্রস্তুতি দেখেছি। তার ওপর আবার এবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এসেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকেও দেখলাম মঞ্চে উপবিষ্ট। তবে ভিভিআইপিদের কথা থাক। আজকের ডায়েরি এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের উদ্দেশে। ঠিক যেমনটা কুম্ভ মেলায় কাতারে কাতারে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসে মানুষ সঙ্গমে স্নান করতে, সেভাবেই রথযাত্রায় নানা রাজ্যের মানুষ! ধনী অভিজাত মানুষ আসেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হল মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। বহু মানুষ হাঁটছেন খালি গায়ে একটা খাটো ধুতি পরে। অনেকে জগন্নাথের ছবি দেওয়া টি-শার্ট পরেছেন। এইসব টি-শার্ট অনেক বড় বড় কোম্পানি এখানে বিনা পয়সায় বিলিও করছে। শহরের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন অলিগলি দিয়ে মন্দিরে মানুষ এসে পৌঁছচ্ছে। আর গলির মধ্যে দিয়ে যখন যাচ্ছি, দু'দিকের সাবেকি বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে, অনেক সময় নীচের রোয়াক থেকে লোকেরা তীর্থ যাত্রীদের গায়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো জল ছেঁটাচ্ছে। এক ধরনের পিচকারি পাওয়া যায় বন্দুকের মতো দেখতে, প্লাস্টিকের তৈরি, সেই পিচকারি দিয়ে জল স্প্রে হচ্ছে। আপনাকে একেবারে ভিজিয়ে দেবে না, অথচ অদ্ভুত একটা প্রশান্তি দেবে। সাধারণ মানুষ মনে করে যে, এটা পুরীবাসীর কর্তব্য অতিথিদের এভাবে স্বাগত জানানো। অনেকে আবার জলের মধ্যে গোলাপ জল মিশিয়ে দিয়েছে। সেই জলে গোলাপের গন্ধ। আবার কোনও কোনও জায়গায় চন্দন জলও স্প্রে করা হয়। এই জল ছেটানোটা ওখানকার একটা প্রচলিত রেওয়াজ।

Advertisement
সুগন্ধী জল ছিটিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানায় পুরীবাসী- ছবি: প্রতিবেদক
সুগন্ধী জল ছিটিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানায় পুরীবাসী- ছবি: প্রতিবেদক

 

আরও পড়ুন

পুরীর এই রথযাত্রার সময় অলিতে-গলিতে জিবেগজার দোকান। আগে দোকানদারেরা মন্দির থেকে সমুদ্র, সর্বত্র নানারকম দোকান দিয়ে থাকে। এটা আমি যতবারই পুরতে এসেছি, দেখেছি। কিন্তু দোলযাত্রার সময় যাদের দোকান নেই, যারা সাধারণ গৃহবাসী, তারাও অনেকে গৃহবধূ, তাদের মেয়েরা প্রচুর পরিমাণে জিবেগজা তৈরি করে ঢেকে রেখে বিক্রি করতে শুরু করে। এটা যতটা না ব্যবসা, তার থেকে বেশি একটা মেলার আনন্দ। এবার দেখলাম, বহু মোড়ে আরআরএস-এর শিবির। এইসব আরআরএস কর্মীরা খাকি হাফপ্যান্ট আর জগন্নাথের ছবি দেওয়া সাদা টি-শার্ট আর মাথায় পরিচিত ক্যাপ পরে মানুষের সাহায্যের জন্য ছোট ছোট বুথ বানিয়েছে। অনেক জায়গায় তারা জলের প্যাকেট বিতরণ করছে। এই যে আরআরএস-এর সক্রিয় ভূমিকা, এবার সম্ভবত রাজ্য স্তরে বিজেপি আসার একটা প্রত্যক্ষ ফল। আরআরএস কর্মীদের সঙ্গে অনেক জায়গায় কথা বলছিলাম। দেখলাম, এরা যত না ওড়িশার, তার থেকে বেশি নাগপুর এবং মুম্বই থেকে এসেছেন। বাংলারও বহু কর্মী এই শিবিরগুলিতে যোগ দিয়েছে। আরআরএস-এর ওড়িশার প্রান্ত প্রচারক এখন বিদ্যুৎ মুখার্জি। তিনি তো কলকাতার বাঙালি শুধু নন, পশ্চিমবঙ্গেই প্রান্ত প্রচারক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এখন থাকেন ভুবনেশ্বর। তাঁর অদৃশ্য ভূমিকা আছে, এমনটা ধরে নেওয়া যায়।


 
মহারাজা গজপতি বীরকিশোর দেব হলেন পুরীর রাজা। জগন্নাথ মন্দিরের মহাপ্রভুর তিনিই হলেন প্রধান এবং প্রথম সেবক। গর্ভগৃহ থেকে প্রভুর বেরিয়ে পথে নামা, সেও এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রথমে জগন্নাথ দেবকে পুরোহিতরা বাতাস করলেন। তাঁকে নামিয়ে যখন আনা হল, তখন পুরীর রাজা সোনার ঝাঁটা দিয়ে সেই ঐতিহাসিক বিখ্যাত ২২টি সিঁড়ি ঝাঁট দিলেন। এই প্রথাই চিরকাল হয়ে এসেছে। শুধু মন্দিরের সিঁড়িতে নয়, তিনি রাস্তায় এসেও ঝাঁট দিলেন রথের দু-ধারের পথ। শাস্ত্র বলে,

রথে পুরীর অলিগলি-- ছবি: প্রতিবেদক
রথে পুরীর অলিগলি-- ছবি: প্রতিবেদক

এই ঝাঁট দেওয়াও একটা প্রতীকী ঘটনা। এই ঝাঁট দেওয়ার অর্থ হল, তমোগুণকে ঝাঁট দিয়ে বিদেয় করা। এই ঝাঁট দেওয়ার অর্থ হল, পাপ এবং মানুষের কাম-ক্রোধ-লোভ, সমস্ত নেতিবাচক জীবনের উপাদানকে দূর হটো বলে ঝাঁট দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। 

রথ সব সময় সামনের দিকে এগোয়। জগন্নাথ দেব পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন। তিনি চলেছেন মাসীর বাড়ি। মাঝপথে তিনি একবার থামবেন। তার কারণ, সেখানে তাঁর জন্য কিছু জল-আহারের ব্যবস্থা করা হবে। তারপর সেই প্রসাদ বিতরণ হবে। ভারতের যে কোনও বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিশেষত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, যেখানে কাতারে কাতারে মানুষ যায়, সেখানে সবসময় বহুজাতিক সংস্থাগুলিও কিন্তু ঢুকে পড়ে। তারা দাতব্য করে, কোথাও বিনা পয়সায় জল দিচ্ছে, বিস্কুটের প্যাকেট বিতরণ করা হচ্ছে। বহু জায়গায় দুপুরবেলায় মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেউ দিচ্ছে খিচুড়ি-আলুর দম, কেউ দিচ্ছে খিচুড়ি-তরকারি। আর শুধু তো বহুজাতিক সংস্থা নয়, দুপুরবেলায় তীর্থযাত্রীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাটা অনেক সময় স্থানীয় গৃহস্বামীরাও করছেন। অনেক মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরাও পুণ্য অর্জনের জন্য তারা শামিয়ানা খাটিয়ে করছেন। অবশ্য তারা চিরকালই এমনটা করে থাকেন। এ ব্যাপারে জৈন সমাজে যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। অনেকে শরবত দিচ্ছে মানুষকে, অনেকে ক্লান্ত পথিকদের বসার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তবে যেভাবে কাতারে কাতারে মানুষ এসেছে, তাতে ঠিক কত সংখ্যায় মানুষ এসেছে, সেটা সরকারি তথ্য পেলে তখন জানতে পারব। 

গতকাল পুলিস স্টেশনে নেমেই দেখেছি, বিরাট একটা এলাকা জুড়ে মানুষের থাকার জন্য একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক যেরকম কুম্ভ মেলায় হয়, ঠিক যেভাবে কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী মেলায় হয়। ভারতের বহু তীর্থস্থানে এ দৃশ্য দেখা যায়। আমরা হরিদ্বারে অর্ধকুম্ভতেও দেখেছি। সেই একই ভাবে ডেরা বানিয়ে সেখানে বহু মানুষ বসবাস করছে। দক্ষিণ ভারতের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, একসঙ্গে দল বেঁধে আসা আর একসঙ্গে থাকা। জগন্নাথ মন্দিরের সামনে চা খাচ্ছিলাম। দেখছিলাম, এক বাঙালি যুবক কলকাতা থেকে এসেছে। এখনও সে ছাত্র। সে বলল, হোটেল পাইনি। তার হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে, ট্রেনে করে চলে এসেছে। এখানে এসে সে সারাদিন ধরে ঘুরেছে, রথযাত্রায় অংশ নিয়েছে। এখন ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, কিন্তু কোনও হোটেলে ঘর পায়নি সে। অথচ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ওই রাস্তায় শুয়ে পড়বে, সেটাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের সেই সমস্যা রয়েছে। সেই কারণে আজ রাতের ট্রেন ধরে আবার কলকাতায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কত বিচিত্র জীবন! নানান রকমের মানুষ! তাদের কতরকমের ইচ্ছে! এই রথযাত্রার ভিড়ের চরিত্র না বুঝলে ভারতীয় মনন বোঝা খুব কঠিন! 

Advertisement

চলবে...
 

Advertisement