একদিকে পবিত্রতা, শুভ্রতার প্রতিমূর্তি মা দুর্গা, অন্যদিকে তাঁর মূর্তি তৈরিতেই দরকার হয় তথা কথিত ‘অশুচি’, ‘অপবিত্র’ এলাকার মাটির ৷ এক পুজো চলে যেতেই শুরু হয়ে যায় পরের বছরের পুজোর প্রস্তুতি পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই কুমোরটুলির ব্যস্ততা ওঠে তুঙ্গে। কাদা মাখা শিল্পী হাত থামতেই চায় না ৷ মৃন্ময়ীরূপে জেগে ওঠেন মা দুর্গা ৷ একমেটে, দোমেটে থেকে ধাপে ধাপে পূর্ণ অবয়বে ফুটে ওঠেন তিনি ৷ কিন্তু শাস্ত্র বলে সেই আদলকে ফুটিয়ে তুলতে কয়েকটি জিনিস আবশ্যক ৷ যেমন, গাভীর মূত্র, গোবর, ধানের শিস, পবিত্র গঙ্গার জল আর নিষিদ্ধপল্লীর মাটির মিশ্রণে তৈরি হবে দেবীমূর্তি ৷ আর সেই কারণেই সেই পুরাকাল থেকে আজও দেবীর মূর্তি তৈরিতে দরকার হয় বেশ্যালয়ের মাটি ৷ কিন্তু কেন এই রীতি ? সমাজে যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে, অবজ্ঞা আর বঞ্চনার পাহাড় জমে উঠেছে যাঁদের দেওয়াল বেয়ে, ঘৃণা আর নোংরা দৃষ্টি ছাড়া যাঁদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি তাঁদের ঘরের মাটিই আবার দেবীমূর্তির অপরিহার্য অঙ্গ ৷ কিন্তু কেন ? চণ্ডী পুরাণেও কি এই রীতি রয়েছে?
এই রীতিটির যৌক্তিকতা নিয়ে আজতক বাংলা-কে জানিয়েছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পুরাণবিদ ও ইতিহাসবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি (Nrisingha Prasad Bhaduri)। 'Custom has the force of Law'। নৃসিংহপ্রসাদের কথায়, 'অনেক কিছুই পরে তৈরি হয়েছে, যা পুরাণে নেই। মহাভারতে নেই, রামায়ণে নেই। আসলে মানুষ তো নিয়ম তৈরি করবেই। তাহলে এই রীতির পিছনে থাকা কারণটা কী। তিনি জানিয়েছেন , দুর্গাপ্রতিমা তৈরিতে শুধু যৌনপল্লিরর মাটি ব্যবহারের রীতি রয়েছে তা নয়, আরও অনেক রকম মাটির কথাই বলা হয়েছে। যেমন শুয়োরের খাত, অর্থাৎ শুয়োর যে মাটি কেটেছে, সেই মাটি নিয়ে আসা। এছাড়াও হাতি দাঁত দিয়ে যে মাটি কেটেছে, সেই মাটি। তবে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, হাতি যে দাঁত দিয়ে মাটি কাটে না, সেটা কে বুঝবে।
এরপরই নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি জানিয়েছেন যে এই সকল চিন্তা-ভাবনার অনেক পরে তৈরি হয়েছে। জমিদারবাড়ির লোকেরা যখন পুজো শুরু করেন, তখন তাঁরাই তৈরি করেছেন এই নিয়ম। পুরাণে এরকম কোথাও উল্লেখ নেই যে যৌনপল্লির মাটি দিয়েই দুর্গাপুজো হবে। কিন্তু কেন এই রীতির জন্ম হল? নৃসিংহপ্রসাদের কথায়, 'দুর্গাপুজো যেহেতু মহোত্সব, তাই ওই সময় সমাজে জাতিভেদ, অন্তজ শ্রেণি ইত্যাদি মনে রাখা হয় না। এটা হল সবচেয়ে বড় যুক্তি। যেমন, সমাজে নানা অস্পৃশ্যতা রয়েছে, ব্রাহ্মণ নিম্নজাতিকে ছোঁবে না, আবার ডোম যে মাদুর তৈরি করত, তার উপর পেতেই লোকে বসেছে। সেরকমই যৌনপল্লি থেকে মাটি এই কারণেই নিয়ে এসো, যাতে আমরা যৌনকর্মীদের ঘৃণা না করি। তাঁরাও তো সমাজের একপ্রকার উপকার করছেন। চণ্ডীর মধ্যে একটা শ্লোক আছে, স্ত্রেয়ঃ সমত্সা সকলা জগত্সু। অর্থাত্, সব স্ত্রী-ই আমি, অন্য কেউ নেই। দেবী বলছেন, এই যে ব্রাহ্মবাদী ভক্তি, এই যে ব্যপ্তি, সর্বত্র তিনি-ই আছেন। তাই যৌনপল্লির মাটি মিশিয়ে নেওয়া হয় দুর্গাপ্রতিমা তৈরির মাটির সঙ্গে।'