রাজ্য সরকারের ডিএ-মামলার (Dearness Allowance) শুনানি সোমবার। সুপ্রিম কোর্টের এই শুনানির দিকে নজর রাজ্যের সরকারি কর্মীদের। মামলাকারী ৩ সংগঠনের আশা, সোমবার মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের পক্ষেই রায় দেবে। মহামান্য হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছে, তাই বলবৎ রাখবেন মহামান্য বিচারপতি দীনেশ মহেশ্বরী ও শ্রী হৃষীকেশ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ।
কী এই মামলা ?
কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় হারে রাজ্যের কর্মীদের ডিএ (Dearness Allowance) দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর জলঘোলা কম হয়নি। সরকার এই রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিল মহামান্য হাইকোর্টে। সেই আর্জি খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখেন মাননীয় বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্ত ও হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। তারপরও ডিএ কার্যকর করেনি সরকার। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যসচিব ও অর্থ সচিবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। সেই মামলার মধ্যেই রাজ্য সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে স্পেশাল লিভ পিটিশন (Special Leave Petition) দাখিল করা হয়। তারই শুনানি সোমবার। মামলাকারী সংগঠনগুলির আশা এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হবে না। আর মামলা গৃহীত না হলে হাইকোর্টের যে রায়, তাই বাস্তবায়িত করতে হবে রাজ্য সরকারকে। অর্থাৎ AICPI অনুযায়ী
DA দিতে হবে।
মামলায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের পাল্লা ভারী
মামলাকারী সংগঠন ও আইনজীবীদের একাংশের মতে, এই সোমবার রাজ্য সরকার চাইবে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হোক। তবে মামলা গ্রহণ করার আগে সব পক্ষের বক্তব্য শুনতে পারেন মহামান্য বিচারপতিরা। আর এই বক্তব্য শোনার পরই মামলা ডিসমিস করতে পারে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। এমন মনে হওয়ার কারণ কী ?
আইনজীবীদের যুক্তি-
১) ২০১৬ সাল থেকে মামলা চলছে। এই মামলার দু’টি বিষয় ছিল। প্রথমত, রাজ্য সরকারি কর্মীরা কেন্দ্রীয় হারে ডিএ পাবেন কি না? দ্বিতীয়ত, অন্য রাজ্যে কর্মরত এ রাজ্যের কর্মীরা কেন্দ্রীয় হারে ডিএ পেলে, এ রাজ্যের সরকারি কর্মীরা কেন তা পাবেন না। কেন এই বৈষম্য? দুই ক্ষেত্রেই SAT ও মহামান্য হাইকোর্ট আগেই নির্দেশ দিয়েছে ডিএ রাজ্য সরকারি কর্মীদের দিতে হবে।
২) মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, ডিএ পাওয়া রাজ্যের সরকারি কর্মীদের সাংবিধানিক অধিকার। রাজ্যের দয়ার দান নয়। নিজের ইচ্ছের উপর রাজ্য ডিএ দেবে এমনটা হতে পারে না। তাদের ডিএ মেটাতেই হবে।
৩) রাজ্য এর আগে যে হলফনামা হাইকোর্টে দিয়েছিল, সেখানে উল্লেখ করেছিল, যে হারে ডিএ দাবি করা হচ্ছে তা দিলে রাজ্যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসবে। আইনজীবীরা মনে করছেন, এক্ষেত্রে অন্য রাজ্যের সরকারি কর্মীরা ডিএ পাচ্ছেন সেই যুক্তি দিতে পারেন সরকারি কর্মীদের আইনজীবীরা।
৪) আইনজীবীরা জানাতে পারেন, এই রাজ্য়ের বিদ্যুৎ কর্মীদের ডিএ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের জন্য তহবিল গড়া হচ্ছে। তাহলে রাজ্যের সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে কেন এই বঞ্চনা ?
আরও পড়ুন : ডিএ নিয়ে বড় খবর, ডিসেম্বরেই মোটা টাকা পাবেন সরকারি কর্মীরা!
৫) দিল্লির বঙ্গভবনে কর্মরত সরকারি কর্মীরাও রাজ্য সরকারের। তাঁদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়া হচ্ছে। তাহলে রাজ্যে বসবাসকারী সরকারি কর্মীরা কী দোষ করলেন?
৬) SAT-আগেই জানিয়েছে, AICPI অনুযায়ী ডিএ দিতে হবে। রাজ্য সরকারও এই নিয়ম ফলো করে বলেই জানিয়েছিল। অথচ তারা এখন সেই নিয়মই মানছে না। সুতরাং রাজ্যের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
৭) রাজ্য সরকার যদি AICPI ফলো না করত তাহলে তাদের রোপা ২০০৯ সংশোধনী আনা প্রয়োজন ছিল। এবং তাদের জানাতে হত, রাজ্য সরকারি কর্মীদের স্বার্থে তারা AICPI ফলো না করে নিজস্ব বিধি লাগু করেছে যাতে সরকারি কর্মীদের সুবিধা হয়। আইনজীবীরা যুক্তি দিতে পারেন, রাজ্য সরকার এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। আবার তারা AICPI-ও ফলো করছে না।
৮) আইনজীবীরা আরও যুক্তি দেবেন, গোটা দেশেই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে সেই হারে ডিএ বেড়েছে। অথচ ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরাও চলতি বছর থেকেই ৩৮ শতাংশ হারে ডিএ পাচ্ছেন। সুতরাং, তাঁরা যে সুবিধে পাচ্ছেন তার থেকে বঞ্চিত রাজ্যের কর্মীরা।
কেন এই রায় ঐতিহাসিক হতে পারে?
সোমবার মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যদি রাজ্য সরকারের SLP খারিজ করে দেয় সেক্ষেত্রে তা ঐতিহাসিক রায় হবে বলেই মনে করছেন আইনজীবী ও সরকারি কর্মচারি সংগঠগুলি। তাদের যুক্তি, ডিএ নিয়ে এই মামলা সেই ২০১৬ সাল থেকে চলছে। SAT ও মহামান্য হাইকোর্ট একাধিকবার সরকারি কর্মীদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তবে সরকার তা কার্যকর করেনি। এই পরিস্থিতিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট SLP ডিসমিস করলে তা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। কারণ, সরকার দিনের পর দিন এই মামলায় লড়েছে, টাকা খরচ করেছে শুধুমাত্র ডিএ থেকে বঞ্চিত করার জন্য।
আবার আইনজীবীদের যুক্তি, সুপ্রিম কোর্টের রায় দেশের আইন হিসেবে গণ্য হয়। সোমবারের রায় যদি রাজ্য সরকারের বিপক্ষে যায় তা হবে, গোটা দেশের সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মীদের জয়। কারণ, বিভিন্ন রাজ্য ডিএ, এরিয়ার ইত্যাদি নিয়ে বঞ্চনা করার চেষ্টা করে সরকারি কর্মীদের। মামলা করে আদালতে। সেক্ষেত্রে এই মামলার রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিজেপি-কংগ্রেস-বাম যে সরকারই রাজ্যে শাসন করুক না কেন, সবাইকে এই নির্দেশ মানতে হবে।
প্রতিক্রিয়া
সোমবারের এই মামলা যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা একবাক্যে মানছে সরকারি কর্মচারি পরিষদ, কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্মেন্ট এমপ্লয়িজ ও ইউনিটি ফোরাম।
সরকারি কর্মচারি পরিষদের সভাপতি দেবাশিস শীল বলেন, 'SAT থেকে শুরু করে হাইকোর্ট এখনও পর্যন্ত ডিএ নিয়ে আইন মোতাবেক যে রায় দিয়েছে তা সরকারি কর্মীদের পক্ষে। আমাদের বিশ্বাস সুপ্রিম কোর্টেও সেই রায় বহাল থাকবে। মুখ পুড়বে রাজ্য সরকারের। রাজ্য বারবার চেষ্টা করেছে সময় নষ্ট করার। তারা সুপ্রিম কোর্টেও গেছে। এখন তারা চেষ্টা করবে এই মামলা যেন সেখানে গৃহীত হয়। তবে আমাদের আইনজীবীরাও তৈরি। সরকারকে এখনও বলব, তারা বকেয়া মিটিয়ে দিক। তবেই মান সম্মান থাকবে। না হলে রাজনৈতিকভাবে সরকারকে অসুবিধের মধ্যে পড়তে হবে।'
কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্মেন্ট এমপ্লয়িজের মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, 'রাজ্য সরকার ডিএ কার্যকর করেনি। তবে এবার তাদের করতেই হবে। আমাদের আশা মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের আবেদন ডিসমিস করে দেবে। আগেও বলেছি, এই সরকারকে ডিএ দিতেই হবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সোমবারের রায় থেকে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।'
কবে মিলবে ডিএ?
সোমবার যদি এই মামলা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ডিসমিস হয়ে যায় তাহলে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের ডিএ মেটানোর যে রায় তা বলবৎ থাকবে। আবার ৭ তারিখে আদালত অবমাননার মামলা রয়েছে মহামান্য হাইকোর্টে। সেদিনই হাইকোর্ট চূড়ান্ত নির্দেশ দিতে পারে রাজ্যকে। সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে। আইনজীবীদের একাংশের মতে, তখন আর রাজ্য সরকারের ডিএ মেটানো ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।