রবিবার সারাদিন রাজ্য সরগরম ছিল ডায়মন্ডবারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআই নোটিস পাঠানো নিয়ে । কয়লা-কাণ্ড নিয়ে কথা বলতে চেয়ে অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নারুলাকে গতকাল নোটিস দিয়েছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি দল হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে অভিষেকের বাড়ি ‘শান্তিনিকেতন’-এ গিয়েছিল। সেখানেই তারা ওই নোটিস দিয়ে আসে। এর জবাবে মঙ্গলবার সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার সিবিআই-কে ইমেল পাঠিয়ে তিনি এমনইটাই জানিয়েছেন বলে খবর। এবারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে 'ভাইপো' ইস্যুতে এমনিতেই গেরুয়া শিবির আক্রমণ শানিয়ে চলেছে। এবার রুজিরাকে সিবিআই নোটিস নিয়ে নতুন করে রাজনীতির ময়দানে অভিষেককে নিশানা করছে বিজেপি। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও অভিষের ঘরণীকে নিয়ে কিন্তু বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। লোকসভা ভোটের আগেই এই নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় উঠেছিল। রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নারুলার নাগরিকত্ব নিয়ে সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিল বিরোধী শিবির।
রুজিরার জন্ম ব্যাঙ্ককে, তাই তাঁর কাছে থাই পাসপোর্ট রয়েছে। কিন্তু একাধিক সরকারি কাগজপত্রে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক বলে পরিচয় দিয়েছেন অভিষেক ঘরণী। তাঁর এই দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। সময়টা ছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের প্রাক মুহূর্ত। সেই বছর ১৫ মার্চ কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিতর্কিত ঘটনাটি ঘটেছিল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী ব্যাঙ্কক থেকে ফেরার সময় তাঁর ব্যাগ পরীক্ষা করতে চেয়েছিল শুল্ক দফতর। তাঁর ব্যাগে হিসেব বহির্ভূত সোনা রয়েছে এমন অভিযোগে শুল্ক দফতর সমন পাঠিয়েছিল রুজিরাকে। যদিও ২০১৯ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাইকোর্ট রুজিরাকে শুল্ক দফতরের সেই নোটিস থেকে অব্যাহতি দেয়। তবে তাঁর ভারতীয় ও থাই দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে চলা মামলাটি এখনও বিচারাধীন রয়েছে।
মিথ্যা বক্তব্য দেওয়া ও প্রকৃত তথ্য লুকানোর অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা নরুলাকে ২০১৯ সালে শোকজ করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বিদেশ নাগরিক বিভাগ। নিজের ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ড এবং প্যান কার্ড পাওয়ার জন্য রুজিরা ওই তথ্য দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল তারা। শোকজ নোটিস অনুযায়ী রুচিরা ওসিআই এবং প্যানকার্ডের জন্য দেওয়া বিবৃতিতে তিনি যে থাইল্যান্ডের বাসিন্দা, সেই তথ্য চেপে গিয়েছিলেন। ১৫ দিনের মধ্য জবাব না দিলে তাঁর পার্সন অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন বা পিআই ও কার্ড (নং. পি২৩৪৯৭৯) বাতিল হয়ে যাবে এমনটা জানান হয়েছিল। কার্ডে নিফন নকুলাকে রুজিরার বাবা হিসেবে উল্লেখ করা আছে। কার্ডটি ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি ব্যাঙ্ককের ভারতীয় দূতাবাস থেকে দেওয়া হয়েছিল। পরে পিআইও কার্ডের আবেদনের সময় রুজিরা তাঁর বিয়ের সার্টিফিকেট দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবার নাম গুরশরণ সিং আহুজা।
বিয়ের আগে রুজিরার পদবি ছিল নারুলা। ২০১০ সালে ব্যাঙ্ককের ভারতীয় দূতাবাস থেকে পার্সন অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন বা PIO কার্ড পান রুজিরা নারুলা। সেই কার্ডে আবেদনকারীর বাবার নাম ছিল নিফন নারুলা। ২০১৭ সালে PIO কার্ডটিকে ওভারসিজ ইন্ডিয়ান সিটিজেন বা OCI কার্ডে রূপান্তরিত করার জন্য কলকাতার ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে আবেদন করেন সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। OCI কার্ড পেয়েও যান তিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি ছিল, নিয়মমাফিক OCI কার্ড পাওয়ার জন্য বিয়ের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন রুজিরা। সেই সার্টিফিকেটে আবার দিল্লির বাসিন্দা গুরশরণ সিং আহুজা নামে এক ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেকারণেই শোকজের মুখে পড়তে হয়েছিল ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরাকে। কেন তিনি এমন কাজ করেছেন, তা জানতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
অভিষেকের সঙ্গে রুজিরার বিয়ে হয়েছিল ২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তার কয়েকমাস আগেই রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মমতার বড় দাদা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে। তৃণমূলে দ্বিতীয় ইন কমান্ড হিসাবেই পরিচিত অভিষেক। উচ্চমাধ্যমিকের পর আইআইপিএম থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে দিল্লি গিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানে পিসি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকতেন তিনি। স্থানীয় অভিভাবক ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ রতন মুখোপাধ্যায়। আইআইপিএমে পড়াশোনার সময়ই রুজিরার সঙ্গে আলাপ হয় অভিষেকের। বন্ধুত্ব থেকে তা গড়ায় ভালবাসায়। কলেজ থেকে সুইজারল্যান্ডে ট্রেনিংয়ে গিয়ে সম্পর্ক আরও দানা বাঁধে। রুজিরা দিল্লির রাজৌরি গার্ডেনের বাসিন্দা। রাজধানীর গফ্ফর মার্কেটে তাঁর বাবার একটি মোবাইলের দোকান রয়েছে, যা বেশ জনপ্রিয়। সূত্রে বলছে, রুজিরার বাবা ও কাকা দুই বোনকে বিয়ে করেছিলেন। পরে তাঁরা ব্যাঙ্ককে রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসা শুরু করেন। রুজিরার জন্মও ব্যাঙ্ককে। পরবর্তীতে তিনি দিল্লি আসেন। কায়লাকাণ্ডে রুজিরাকে সিবিআই নোটিস পাঠাতেই ফের তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি শিবির।
রুজিরার বোন মানেকা গম্ভীর রুবি হাসপাতালের কাছে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। কয়লা কেলেঙ্কারিতে তাঁকে নোটিস পাঠিয়েছে সিবিআই। জানা যায় দিল্লিতে অভিষেক ও রুজিরার বিয়ের এলাহি আসর বসেছিল। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থাকতে না পরালেও তাঁর দলের অনেক নেতাই হাজির হয়েছিলেন সেই রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। মেয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসার জন্য রাসবিহারী এলাকায় বাড়িও কিনেছিলেন রুজিরার বাবা-মা। অভিষেকও পরিবারের সঙ্গে ব্যাঙ্ককে গিয়েছেন। রুজিরা ও অভিষেকের দুই সন্তান রয়েছে। কন্যার নাম আজানিয়া। ২০১৯ সালে তাঁদের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ছেলের নাম তাঁরা আয়ানাশ রেখেছেন।