তিনি ক্রিকেটার মহারাজ। আর তাকে নিয়েই গত কয়েকদিন হল চলছে জোর রাজনৈতিক চর্চা। এমনকি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পরেও সেই জল্পনা কমার বদলে আরও বেড়েছে। সৌজনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তা। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল যেভাবে প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে তাতে সব মিলিয়ে ভোটগন্ধই পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল। লা-জবাব। এহেন সৌরভের নাম যখন রাজনীতির অলিন্দে ভেসে ওঠে তখন তা নিয়ে যে ঝড় উঠবে বলাই বাহুল্য। ২০২১-এ বাংলা দখল করতে ভারতীয় জনতা পার্টি যখন সর্বস্ব দিয়ে এরাজ্যে নেমেছে তখন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে সৌরভের সৌজন্য সাক্ষাৎ ও তার পরেই মহারাজের দিল্লি উড়ে যাওয়া নতুন মাত্রা যোগ করেছিল তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক মহল তো বটেই, ক্রিকেট মহলেও কৌতূহল ছড়ায় এই প্রশ্নে— সৌরভ সত্যিই রাজনীতিতে আসছেন? বিধানসভা নির্বাচনের আগে বঙ্গে বিজেপির মুখ হতে তিনি কি সম্মত হচ্ছেন? যদিও দিল্লির স্টেডিয়ামে অরুণ জেটলির মূর্তি উন্মোচনে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হিসাবে সৌরভের উপস্থিত থাকা ও তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাজির হওয়া একেবারেই প্রটোকল মেনে। এর সাথে রাজনীতির কোনও যোগই নেই। কিন্তু দিল্লির কোনও কোনও মহলে এমন খবরও ছড়িয়ে পড়েছিল, ফিরোজ শাহ কোটলার অনুষ্ঠান সেরে সৌরভ হয়তো অমিত শাহের বাংলোয় যাবেন। তবে সেই সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেদিন রাতেই বিমানেই দিল্লি ফিরে আসেন মহারাজ। আর তার সাত দিন না কাটতেই সৌরভের অসুস্থ হয়ে পড়া। অসুস্থ সৌরভকে নিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক শিবিরের উদ্বেগ বেড়েছে তাতে এক নতুন সমীকরণ দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনই দেশের অন্যতম সফল এবং সেরা ক্রীড়াবিদ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ক্রিকেট মহলের পাশাপাশি গোটা দেশই উদ্বিগ্ন ছিল প্রিয় ‘দাদা’র অসুস্থতা নিয়ে। আর এই উদ্বেগের মাঝেই নজর কেড়েছে তাঁকে নিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি শিবিরের তৎপরতা। একদিকে বিজেপি শিবিরে প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সৌরভকে ফোন করে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেন তখন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং হাজির হচ্ছেন হাসপাতালে। পাশাপাশি নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়তো লেগেই রয়েছে যে হাসপাতালে সৌরভের চিকিৎসা চলছে সেখানে।
শনিবার দুপুরে সৌরভ হাসপাতালে ভর্তি হতেই উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্যুইট করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে অসুস্থ সৌরভকে স্বচক্ষে দেখেও আসেন তিনি । এ ছাড়া হাসপাতালে গত কয়েকদিন ভিড় লেগেছিল রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, লক্ষ্মীরতন শুক্লা, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়দের। অন্যদিকে বিজেপি শিবিরের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং মুকুল রায় থেকে সদ্য দলে আসা শুভেন্দু অধিকারী সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সৌরভের খোঁজ নিতে। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর থেকে উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী সকলেই হাজির হন হাসপাতালে। বার বার খোঁজ নিতে থাকেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং। রবিবার ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও। এমনকি শনিবার হাসপাতালে হাজির হন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও।
কিছু দিন ধরেই সৌরভের নাম নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জোর চর্চা চলছে। তিনি আগামী নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির ‘মুখ’ হতে পারেন, এমন জল্পনা ধাপে ধাপে দানা বাঁধছে। এই আবহে তাই সৌরভের খোঁজ নিতে বিজেপি ও তৃণমূলের অতিসক্রিয়তা সকলেরই নজর কেড়েছে। তবে পিছিয়ে নেই বাম শিবিরও। সীতারাম ইয়েচুরি থেকে সুজন চক্রবর্তী সকলেই হাজির হয়েছেন হাসপাতালে। সৌরভকে দেখতে কলকাতায় চলে এসেছেন রাজ্যের প্রাক্তন পৌর ও নগরোন্নায়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভট্টাচার্য পরিবারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কয়েকদিন আগে সৌরভের বাড়িতে একসঙ্গে বসে খেয়েছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। সেই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন তিনি। এর আগেও অশোক ভট্টাচার্য কোরোনায় আক্রান্ত হওয়ার সময় সৌরভ নিয়মিত তাঁর খোঁজ-খবর নিয়েছেন। রাজনীতির রং না লাগিয়েই সেই বন্ধুত্ব অটুট থেকেছে। সেই সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য রীতিমতো বিতর্ক উস্কে দাবি করছেন, নিজেদের ‘রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি’-র জন্য কেউ কেউ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ব্যবহার করছেন। তাঁর উপর 'চাপ' তৈরি করা হয়েছিল।
সৌরভ সম্পর্কে বলা হয় তিনি ভাল 'থিঙ্কার'। যে করেন ভেবে করেন। আচমকা এমন কোনও সিদ্ধআন্ত নেবেন না, যা নিয়ে তাঁকে পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে হয়। সৌরভের বিশ্বস্ত মহল মনে করে, তার একটি পদক্ষেপই ভ্রান্ত ছিল, সেটি গ্রেগ চ্যাপলকে ভারতে কোচ করে আনা। এই একটি পদক্ষেপ তাঁর কাছে বুমেরাং হিসেবে অবতির্ণ হয়েছিল। অতীতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বহু চাপ একাই সামলেছিলেন বাংলার মহারাজা। ভারতীয় ক্রিকেটের 'কামব্যাক ম্যান' হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিরন্তর লড়াই করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। এবার রাজনীতির ময়দানে তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া ঠান্ডা যুদ্ধ মহারাজ কিভাবে সামলান সেটাই এখন দেখার।