দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। কলকাতা পুরনিগমের ডেপুটি মেয়র হিসাবে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব সামলেছেন। উত্তর কলকাতায় রয়েছে যথেষ্ট প্রভাব। সেই সঙ্গে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। দীর্ঘদিন পুর রাজনীতিতে সফল হলেও বিধানসভায় কোনওবার টিকিট পাননি এহেন অতীন ঘোষ। তবে একুশের ভোটে সেই অতীনের ওপরেই ভরসা রেখেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রে এবার ঘাসফুল চিহ্নে লড়ছেন অতীনবাবু। তাই তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে একুশের ভোট এক মাইলফলক বলাই বাহুল্য।
উত্তর কলকাতার ৭ বারের কাউন্সিলর অতীন ঘোষ
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু। ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সাত বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। মাঝে দু’বার ওই ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত থাকায় সেখানে প্রার্থী হননি। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু। যুব কংগ্রেস থেকে মমতার হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে। তারপরেও দীর্ঘ এতবছর লেগে গেল বিধানসভার টিকিট পেতে। যদিও কাজের মানুষ হিসাবে যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে অতীন ঘোষের। বলা হয় পুর রাজনীতিতে পোড় খাওয়া অতীন এসএন ব্যানার্জি রোর্ডের ছোট লাল বাড়ির সবকটি ইঁটি নাকি চেনেন।
তবুও ববির ডেপুটি হয়ে থাকতে হল
শহরের বড় লালবাড়ি দখলের আগেই ছোট লালবাড়ি এসেছিল তৃণমূলের দখলে। কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতর ছিল অতীন ঘোষের হাতে। ২০১৫ সালের পুরভোটে ফের তৃণমূলের বোর্ড গঠিত হওয়ার পর মেয়র পারিষদ স্বাস্থ্য হন অতীনই। খাদ্যে ভেজাল রোধে বিভিন্ন হোটেল -রেস্তরাঁয় পুর অভিযান চালিয়ে তিনি বরাবরি খবরের শিরোনামে থেকেছেন। ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া রোধেও তাঁর ভূমিকা প্রশংসিত হয়। তাই শোনা যায় শোভন চট্টোপাধ্যায় কলকাতা পুরসভার মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দিতেই দলনেত্রী তাঁকে প্রমোশন দিতে পারেন, এমনটাই ভেবেছিলেন অতীন। কিন্তু দিদি বেছে নিয়েছিলেন বিশ্বস্ত ফিরহাদ হাকিমকে। তবে ডেপুটি মেয়র করা হয় অতীন ঘোষকে। আর এতেই নাকি কিছুটা হলেও অভিমান হয়েছিল অতীন ঘোষের, এমনই বলে থাকেন অনেকে।
শুভেন্দুর পাশে দাঁড়িয়ে বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছিলেন প্রকাশ্যেই
তখনও শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়েননি। তবে শুভেন্দুর সঙ্গে দলের অহি–নকুল সম্পর্ক প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এই আবহেই মুখ খুলেছিলেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য এবং প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ৷ জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক জীবনে বঞ্চিত হয়েছেন, কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে৷ তাই এখন হতাশা বাড়ছে৷ শুভেন্দু অধিকারীর মতো জননেতা দল ছাড়লে তৃণমূলের ক্ষতি হবে৷ তাঁর এই মন্তব্য সেই সময়ে তৃণমূলের অস্বস্তি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনিও কি 'বিদ্রোহী' হচ্ছেন সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল রাজনৈতিক মহলে? অতীন সেই সময় স্পষ্ট বলেছিলেন, 'এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে কখনও দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলিনি৷ অনেক বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে৷ আমাদের মতো কর্মীরা আশা করেন, দলের শৃঙ্খলা যাঁরা প্রকাশ্যে ভঙ্গ করবেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তা না হওয়ায় ক্ষোভগুলি প্রকাশ্যে আসছে।’
তিন দশকের রাজনৈতিক কেরিয়ারে প্রথমবার বিধায়কের টিকিট
উত্তর কলকাতা থেকে প্রায় তিন দশক ধরে কাউন্সিলর নির্বাচিত অতীন ঘোষ দীর্ঘদিন ধরেই মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন৷ যদিও তাঁর ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি৷ সেই ক্ষোভের কথাই শোনা গিয়েছিল অতীন ঘোষের গলায়৷ বর্তমানে যখন দলে যোগ দিয়েই প্রার্থী হওয়ার টিকিট পেয়ে যাওয়া জলভাত হয়ে গিয়েছে তখন অতীনের মত দীর্ঘদিনের রাজনীতিকদের ক্ষোভ সামনে আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এমনটাও শোনা যায় উত্তর কলকাতার মানুষ হওয়াতেই তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার কচ্ছপের মত এগিয়েছে। যোগ্য হওয়া সত্বেও সুযোগ পাননি। অতীন বেসুরো বাজতেই এমনটাও শোনা গিয়েছিল তাঁকে মেয়র প্রজেক্ট করেই কলকাতা পুরনিগমের নির্বাচনে লড়তে চাইছে বিজেপি। এই বিষয়ে তাঁকে 'টোপ' দেওয়াও হয়েছে। তবে আর সবার মত বিদ্রোহী হয়ে দল ছাড়েননি অতীন। তার পুরস্কারও এবার নেত্রী দিয়েছেন। পুরনিগমের জনপ্রিয় মুখ অতীনকে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড় করানো হয়েছে কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্র থেকে।
কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের অতীত
সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশনের নির্দেশ অনুসারে কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্রটি গঠিত হয়েছে কলকাতা পুরসভার ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডগুলি নিয়ে। ২০১১ সালে এই কেন্দ্রে জয়লাভ করেন তৃণমূলের মালা সাহা। সেবার মালার দখলে গেছিল ৬১.৬৭ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালেও এই কেন্দ্রে জিতেছিলেন মালা সাহা। তবে এবার মালা সাহার পরিবর্তে তৃণমূল ভরাস রেখেছে অতীন ঘোষের ওপরই। তাঁর নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা হতেই জোরকদমে প্রচারের ময়দানেও দেখা যাচ্ছে অতনীকে। জয়ের ব্যাপারেও ১০০ শতাংশ নিশ্চিত বেলগাছিয়া কাশীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী অতীন ঘোষ।
কাশীপুর-বেলগাছিয়ায় প্রার্থী বদল বিজেপির
অতীন যখন গুছিয়ে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন তখন কিছুটা হলেও বেকায়দায় গেরুয়া শিবির। বিজেপি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল উত্তর কলকাতার কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্রে । এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে নাম ঘোষণা করে তরুণ সাহার ৷ তিনিও রাজনীতিতে যথেষ্ট পরিচিত মুখ। কলকাতা পৌরনিগমের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তথা তৃণমূল নেতা তরুণ সাহা । কলকাতার বোরো-১ এর চেয়ারম্যান পদ সামলেছেন দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ৷ কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রে তিন বারের বিধায়ক তাঁর স্ত্রী মালা সাহা । ২০০৬ সালে দাপুটে বামপন্থী শ্রমিক নেতা রাজদেও গোয়ালাকে হারিয়ে প্রথমবার বিধায়ক হয়েছিলেন মালা সাহা । তখন ওই কেন্দ্র ছিল বেলগাছিয়া । তাই বিজেপির প্রার্থী তালিকায় তৃণমূল নেতার নাম থাকায় বেলগাছিয়া-কাশীপুর কেন্দ্র নিয়ে নতুন জল্পনা ছড়ায় । যদিও সব জল্পনার অসান ঘটিয়ে এলাকার বিদায়ী বিধায়ক মালা সাহার স্বামী তরুণ সাহা সাফ জানিয়ে দেন, তিনি বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন না। যার ফলশ্রুতি এই কেন্দ্রে প্রার্থী বদলায় গেরুয়া শিবির। কাশীপুর-বেলগাছিয়ায় প্রার্থী হন শিবাজী সিংহরায়। যিনি আবার বিজেপির উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি।
জল্পনা হয়েছিল মিঠুনের নাম নিয়েও
গত ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিগ্রেড সমাবেশে গেরুয়া পতাকা হাতে নেন মিঠুন চক্রবর্তী। তার পরেই কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে দেখা যায় মহাগুরুকে । তাতে জল্পনা শুরু হয়েছিল তবে কি এবার প্রার্থী তালিকাতেও থাকতে পারে তাঁর নাম? রাজনৈতিক মহলে এই নিয়ে জোর গুঞ্জন শুরু হয়। বিজেপির সূত্রে জানা যায়, বেলগাছিয়ার রাজা মণীন্দ্র রোডে বোনের বাড়ির ঠিকানাতেই ভোটার তালিকায় নাম তুলেছেন মিঠুন। যদিও শেষপর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে নামেননি মহাগুরু। বরং বিজেপির তারকা প্রচারক হয়ে সারা রাজ্য চষে বেড়াচ্ছেন।
কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রটি কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ২০০৯, ২০১৪-মত ২০১৯ এও এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ হয়েছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বিধানসভায় এই কেন্দ্র থেকে ২৫,৮১০ ভোটের ব্যবাধানে সিপিএমের কনীনিকা বসু ঘোষকে হারিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। ২০১১ সালে জয়ের ব্যবধানটা ছিল ৪০,২৮৪ ভোট। তবে গত ৫ বছরে এখানে বিজেপির উত্থান হয়েছে চোখে পড়ার মত। তাই এবার মূল লড়াই তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। যদিও ময়দানে রয়েছেন সিপিএম প্রার্থী প্রতার দাশগুপ্তও। গত লোকসভার নিরিখেও কাশীপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। তাই কিছুটা হলেও এই কেন্দ্রে অ্যাডভান্টেজ পুরনিগমের জনপ্রিয় মুখ অতীন ঘোষই। ২০১৬ সালে একবার শোনা গিয়েছিল জোড়াসাঁকো থেকে প্রার্থী হতে পারেন অতীন। শেষপর্যন্ত তা হয়নি। তবে একুশে শিকে ছিঁড়েছে। একুশের ভোট অনেক পালাবদলের সাক্ষী থাকছে। এবার তাঁর কাউন্সলির থেকে বিধায়কে প্রমোশন হচ্ছে কিনা, অতীনের ভাগ্যপরীক্ষা আগামী ২৯ এপ্রিল।