একুশের ভোটে সব নজর নন্দীগ্রামে দিকে, তার জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে নন্দীগ্রামের বাইরেও এমন কিছু কেন্দ্র রয়েছে যেখানকার লড়াই হয়ে উঠতে চলেছে চমকপ্রদ। যার মধ্যে নাম নিতেই হবে উত্তর চব্বিশ পরগনার বিধাননগরের। যেখানে এলাকার বিদায়ী বিধায়ক তথা রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুর মুখোমুখি হতে চলেছেন একদা তাঁর সহযোদ্ধা বর্তমানে দল বদলে বিজেপির প্রার্থী হওয়া সব্যসাচী দত্ত। ফলে বিধাননগরে সুজিত-সব্যসাচীর ডার্বি যে এবারের ভোটের বাংলায় অন্যতম আলোচনার বিষয় হতে চলেছে তা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই।
সুজিত-সব্যসাচীর সম্পর্ক
সব্যসাচী দত্ত ও সুজিত বসু- দুজনেই দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। সেই সঙ্গে দু’জনে দীর্ঘ সময় ধরে একই এলাকায় রাজনীতি করেছেন। একদা রাজনৈতিক সহকর্মী হলেও দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক কখনই ‘মধুর’ছিল না। তৃণমূল সূত্রের খবর সব্যসাচী দলে থাকাকালীন এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে দু'জনের মধ্যে বিবাদ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একই সঙ্গে তৃণমূলনেত্রীর আনুগত্য লাভের জন্যই সুজিত বনাম সব্যসাচীর লড়াই চলত।
মেয়র পদ নিয়েই যত গন্ডগোল
একসময় সুভাষ চক্রবর্তীর অনুগামী ছিলেন সুজিত বসু। সেখান থেকে শিবির বদল করেন। নতুন দলেও কায়েম করেন আধিপত্য। ২০০৯ সালে বেলগাছিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক সুভাষ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর সেখানে উপনির্বাচন রমলা চক্রবর্তীকে পরাজিত করে প্রথমবার তৃণমূলের বিধায়ক হয়েছিলেন সুজিত বসু। তবে বেলগাছিয়া পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রটি ২০১১ সালে অবলুপ্ত হয়ে। এরপর ২০১১ ও ১৬- নির্বাচনে বিধাননগর কেন্দ্র থেকে জয়ী হন সুজিত বসু। পরবর্তীতে তাঁকে রাজ্যের দমকলমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারও বিধাননগর জয়ে সুজিতের ওপরেই ভরসা রেখেছেন তৃণমূলনেত্রী। অন্য়দিকে সল্টলেকের বাসিন্দা হলেও গত বিধানসভা নির্বাচনে সব্যসাচী দত্ত জিতেছিলেন রাজারহাট নিউটাউন কেন্দ্র থেকে। এদিকে ২০১৫ সালে বিধাননগর পুরনিগমের নির্বাচনে তৃণমূল বোর্ড গঠনের পর মেয়র করা হয়েছিল সব্যসাচীকে। জানা যায় বিধননগরের এই মেয়র পদ নিয়েই যত ‘কাণ্ড’। ওই পদ পাওয়ার বাসনা যে সুজিতেরও ছিল, সে কথা দলের অন্দরে কারও অজানা ছিল না। তা থেকেই দু'জনের মধ্যে আরও বেড়েছিল টানাপোড়েন। সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন জুড়েই আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করেছিলেন দু'জনে। যার জেরে মাঝেমধ্যেই মহিষবাথান, দত্তাবাদ, লেকটাউন অঞ্চলে দুই নেতার অনুগামীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসত। দলনেত্রীকেও একসময় মাঠে নামতে হয় দুজনকে সামাল দিতে। বছর দেড়েক আগে বিধাননগর পুরনিগমের মেয়র পদ ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন সব্যসাচী। তখনও অবশ্য সুজিতের কপালে শিকে ছেড়েনি। বিধাননগরের মেয়র পদে বসানো হয় কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে।
বৈরিতা থাকলেও সৌজন্য বজায় রেখেছিল দু'তরফই
দু’জনে বর্তমানে দুই পথে গেলেও কখনই সব্যসাচী ও সুজিত সরাসরি ‘লড়াই’ করেননি। বিধানননগরের মেয়র থাকাকালীনই বিদ্রোহ করেছিলেন সব্যসাচী দত্ত। সুজিত বসুকে মমতা মন্ত্রী করতেই ভিতরে ভিতরে অভিমান জন্মেছিল। শেষপর্যন্ত মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গেরুয়া শিবিরের পতাকা ধরেন সব্যসাচী, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গুরু মুকুল রায়ের হাত ধরে। কিন্তু সুজিতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়ে গিয়েছিল রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়কের। তবুও সেই বৈরিতা ভুলে প্রতিদ্বন্দ্বী করোনা আক্রান্ত হতেই তাঁর শরীরের খোঁজ নিয়েছিলেন সব্যসাচী। জানা যায় গত বছর জুন নাগাদ সুজিত বসু করোনা আক্রান্ত হতে তাঁকে ফোন করেন সব্যসাচী। তখন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী ফোন রিসিভ করতে পারেননি। তাই টেক্সট মেসেজে পুরনো সহকর্মীকে ‘গেট ওয়েল সুন’ মেসেজ পাঠান সব্যসাচী। এর কিছুক্ষণ পরেই সবাইকে অবাক করে কল ব্যাক করেন সুজিত বসু। জানা যায়, বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় দু'জনের মধ্যে।
বিধাননগরের ভোটের হিসেব কী বলছে?
বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্র বারাসত লোকসভা আসনের অন্তর্গত। বারাসত থেকে ২০১৯ সালে তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার জিতলেও সল্টলেকে কিন্তু বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিল গেরুয়া শিবির। পরিসংখ্যান বলছে বিধাননগর বিধানসভা এলাকায় বিজেপির মৃণালকান্তি দেবনাথ পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮৭২টি ভোট। অন্যদিকে কাকলির ঝুলিতে গিয়েছিল ৫৮ হাজার ৯৫৬টি ভোট। অর্থাৎ প্রায় বিশ হাজার ভোটে লিড পেয়েছিল বিজেপি।
জানা যায় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সময় সব্যসাচী দত্ত নাকি শর্ত দিয়েছিলেন তাঁকে বিধাননগরের প্রার্থী করতে হবে। দল সেই শর্ত রেখেছে। অনেকেই বলেন নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারে ঝুঁকি নিয়েই সাধের মেয়র পদ ছে়ড়ে গেরুয়া শিবিরে গিয়েছিলেন সব্যাসাচী। সুজিতের কারণেই মূলত তৃণমূল ছাড়েন সব্যসাচী! তেমনটাই বলেন অনেকেই। তাই রাজনীতির ময়দানে এবার সুজিত বসুকে হারাতে চাইছেন সব্যসাচী। কোনও সন্দেহ নেই সুজিতের শক্ত ঘাঁটি বিধাননগর। এদিকে লোকসভার ভোটের পরিসংখ্যানে বিধাননগরকে ‘সুবিধাজনক' আসন বলেই মনে করছে বিজেপি। বিধাননগর চেনা মাঠ দুই পোড় খাওয়া নেতার কাছেই। অনুগামীরাও পুরনো। ফলে এবার এই কেন্দ্রেও লড়াই যথেষ্ট হাড্ডাহাড্ডি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।