বাংলায় আটদফার ভোটরঙ্গ শুরু হচ্ছে শনিবার থেকে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে চলবে ভোটপর্ব। অষ্টম দফার ভোট ২৯ এপ্রিল। এবার কমিশন বেশিরভাগ জেলাতেই দু'পর্বে ভোট পরিচালনা করছে। ব্যতিক্রম একমাত্র দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। এই জেলাতেই তিনপর্বে হবে নির্বাচন। যার শুরুটা হচ্ছে আগামী পয়লা এপ্রিল। এরপর ৬ এপ্রিল তৃতীয় দফায় এবং ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফায় রয়েছে ভোটগ্রহণ। এবারের নির্বাচনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গুরুত্ব তৃণমূল ও বিজেপি দুই তরফের কাছেই অসীম। দক্ষিণ ২৪ পরগনা তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি হিসাবেই পরিচিত। লোকসভা ভোটের নিরিখে জেলার ৩১টি বিধানসভা আসনই তৃণমূলের দখলে। গত বিধানসভাতেও এখান দাঁত ফোটাতে পারেনি গেরুয়া শিবির। তাই অন্যান্য জেলার তুলনায় উপকূলীয় এই জেলাকে নিয়ে অনেকটাই স্বস্তিতে থাকতে পারত তৃণমূল শিবির। কিন্তু তা আর হোল কই। সৌজন্যে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। এবারের একুশোর ভোট ময়দানে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট নামে নিজের দল গোড়ে ময়দানে নেমেছন পীরজাদা। আর তাতেই নাকি চওড়া হচ্ছে শাহ-নাড্ডাদের মুখের হাসি। চলুন দেখা যাক এর পেছনে কারণটা কী?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভৌগলিক গুরুত্ব
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর পূর্ব দিকে রয়েছে বাংলাদেশ৷ পশ্চিমে হুগলি নদী ও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন৷ এখানেই দেখা মেলে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের৷ আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম ও জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের ৬৪০টি জেলার মধ্যে এই জেলার স্থান ষষ্ঠ। ফলে ভোটারের সংখ্যার দিক থেকে সব রাজনৈতিক দলের কাছেই এই জেলার গুরুত্ব অত্যন্ত বৈশি।
দক্ষিণের রাজনৈতিক পালাবদল
বাম আমলে এই জেলায়া সিপিএমের প্রবল দাপট ছিল। সেই দাপটটাকে ভেঙে দিয়ে এখানে তৃণমূল কংগ্রেস নিজের জমি তৈরি করেছিল। চাকা ঘুড়তে শুরু করেছিলে ২০০৮ সাল থেকেই। ২০০৮ সালে প্রথমবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর ২০১৩ পঞ্চায়েত হোক কিম্বা ২০১৪ লোকসভা সবক্ষেত্রেই বজায় ছিল তৃণমূলের আধিপত্য। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এখানে অপ্রতিরোধ্য ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ রাজ্যজুড়ে প্রবল গেরুয়া ঝড়ের মধ্যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পরাস্ত হয়েছিল বিজেপির অশ্বমেধ ঘোড়া। তাই একুশের ভোটে এই জেলায় আধিপত্য বিস্তার করা ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
অভিষেকের গড় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
রাজ্যে বাম শাসন থেকে পালা বদলের সময় যে কয়েকটি জেলায় তৃণমূল প্রথমে নিজেদের মাটি শক্ত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ ২৪ পরগণা। ২০১৬ বিধানসভায় এই জেলার ৩১টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৯টিতে জিতেছিল তৃণমূল। ২০১৯ লোকসভায় ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরা। এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, এই জেলায় তৃণমূলের শক্তি ঠিক কতটা। তারমধ্যে এই জেলার ডায়মন্ড হারবার থেকেই সাংসদ তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্যত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাকে অভিষেকের গড় বলা হয়। তৃণমূলের প্রথম দিকে এই জেলায় সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর মনে করা হয়েছিল এবার গেরুয়া শিবির তার সাংগঠনিক দক্ষতাকে এই জেলার জন্য কাজে লাগাবে। তবে ভোটের আগে টিকিট না পেয়ে সেই বিজেপি থেকেই বিদায় নিয়েছেন শোভন। ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী আপাতভাবে একুশের ভোটে এই জেলা নিয়ে চিন্তা করার তেমন কোনও কারণ নেই ঘাসফুল শিবিরের। তবে স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না মমতা ও অভিষেক কেউই। তার একটি কারণ যদি আমফান হয় তাহলে অপর কারণ অবশ্যই আব্বাস সিদ্দিকী।
আমফান দুর্নীতি ভোটে প্রভাব ফেলবে?
ঘূর্ণিঝড় আমফানে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার। যাদের ঘর ভেঙেছে তাদের ২০,০০০ টাকা করে দেবে রাজ্য সরকার। নবান্নে এমন ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টাকা যেন নিরপেক্ষভাবে বণ্টন হয় সেজন্য একটি টাস্ক ফোর্সও গঠন করেছিলেন তিনি। অভিযোগ ওঠে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে আমফানের ক্ষতিগ্রস্তরা বাড়ি তৈরির টাকা পাননি। কিন্তু সেই টাকা গেল কোথায়? ত্রাণ বন্টনে রাজ্যের সর্বত্রই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির ভূরি ভুরি অভিযোগ ওঠে। জেলায় জেলায় শুরু হয় বিক্ষোভ। পরিস্থিতির চাপে পড়ে পদক্ষেপ করতে কার্যত বাধ্য হয় সরকার। শোকজ কিংবা বহিষ্কার করা হয় শ'খানেক তৃণমূল নেতা-পঞ্চায়েত-প্রধানকে। আমফানের ত্রাণে দুর্নীতিকে এবার শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র করেছে বিরোধীরা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাংলায় ভোট প্রচারে এসে বারবার আমফান দুর্নীতি নিয়ে বিঁধছেন তৃণমূলকে।
ময়দানে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী
তবে আমফান দুর্নীতির থেকেই এবার বিজেপির সবচেয়ে আশার জায়গা বোধহয় আব্বাস সিদ্দিকী। একুশের নির্বাচনের আগে এবার ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট গড়েছেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। তার লড়াই বিজেপির মত তৃণমূলের সঙ্গে সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা। আত্মপ্রকাশেই রাজ্য রাজনীতিতে নজর কেড়েছেন 'ভাইজান' হিসাবে পরিচিত আব্বাস। ২৮ ফেব্রুয়ারি বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেডে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তা। এহেন আব্বাস ভোট ঘোষণার আগেই ডায়মন্ডহারবারে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন, "তুমি বল দাদাগিরি দেখাবে, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জিরো করে দেব মনে রেখে দিও।" এখানেই থামেননি আব্বাস মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ করেছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, হিন্দু হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার অভিনয় করলেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দেওয়া যায় না। প্রশ্ন করেছেন, মুসলিম সমাজের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এতই উন্নয়ন করে থাকেন, তাহলে এখনও মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়েনি কেন, কেন মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষক নিয়োগ হয় না, কেন কাজ নেই মুসলমান যুবকদের হাতে? দক্ষিণবঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজে কিন্তু এই ফুরফুরা শরীফ ও আব্বাস সিদ্দিকীর দারুণ প্রভাব।
আব্বাসের নজরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এমন একটা জেলা, যেখানে শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম জনগোষ্ঠীও একটা বড় জায়গা দখল করে রয়েছে। তারমধ্যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা। সেটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। তার ফলে সংখ্যালঘু বাঙালি মুসলিম জনসংখ্যা এখানে বিশাল। বিশেষত ক্যানিং, ভাঙর ১, ভাঙর ২, বাসন্তী, জয়নগর ১, জয়নগর ২, মগরাহাট ১, মগরাহাট ২, কুলতলী, ডায়মন্ডহারবার এর মতো এলাকা গুলোতে সংখ্যালঘু ভোটার অনেক। সেই সংখ্যালঘু ভোটবাক্স সম্পূর্ণ তৃণমূলের দিকে চলে এসেছিল। বিধানসভা ভোটে এই এলাকাগুলিতে জোর প্রচার চালাচ্ছে আব্বাস। আইএসএফের হয়ে আব্বাসের প্রচারে বিরাট জনসমাগমে রাজনৈতিক মহলকে আলোড়িত করছে।
আব্বাসের বৃদ্ধিতে বিজেপির স্বস্তি
আব্বাসের নতুন দল গঠন, বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা কোনটিকেই ভালভাবে নেয়নি তৃণমূল। প্রতি পদক্ষেপেই আক্রমণ শানিয়েছে মমতা শিবির। বৃহস্পতিবার সাগরে জনসভা করতে গিয়ে তৃণমূলনেত্রী তোপ দেগে বলেছেন, নিজেদের স্বার্থে ভোট কাটতে টাকা দিয়ে দল বানিয়েছে বিজেপি। যদিও বিজেপির অন্দরে কিন্তু খুশির হাওয়া। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের ২৭ থেকে ৩০ ভাগ মুসলিম ভোটারই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে। গত এক দশক ধরে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের অন্যতম মূল শক্তি ছিল মুসলিম ভোটার। এ বছর ‘ভাইজান’ হিসেবে জনপ্রিয় আব্বাস সিদ্দিকী নির্বাচন করায় মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের একটা বিরাট অংশই মমতার হাতছাড়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৃণমূলের ভোটের নেপথ্যে মুসলিম তোষণনীতি রয়েছে এ অভিযোগ লোকসভা নির্বাচন থেকেই করে আসছে গেরুয়া শিবির। এখন আব্বাস সিদ্দিকী যদি সেই ভোটের মেরুকরণে বিপরীত হাওয়া তোলেন তবে ভোট ভাগাভাগিতে যে তৃণমূলের ‘কিছু কম পড়বে’ সেই আশাতেই ছক কষে নিয়েছেন পদ্ম নেতারা। আর তাই রাজ্যের দক্ষিণের এই জেলায় নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে বিজেপির কাছে আব্বাসের নতুন দল যেন আশীর্বাদ স্বরূপ। তবে তৃণমূল ও আব্বাসের ভোট কাটাকাটিতে বিজেপি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এবার খাতা খুলতে পারে কিনা তার জবাবের জন্য দোসরা মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।